শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদন দেয়ার দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও সুপারিশ বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার ব্যাপারটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পাঁচ মাস পেরিয়েছে। এ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক সংস্কারে মনোযোগ দিলেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় তাদের মনোযোগ কম। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গত শনিবার অনুষ্ঠিত শ্বেতপত্র কমিটি আয়োজিত ‘শ্বেতপত্র অতঃপর: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক সিম্পোজিয়ামে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি-কৌশল নিয়ে এমন পর্যালোচনা উঠে এসেছে।
এ পর্যালোচনার সঙ্গে সহমত পোষণ করেই বলতে হয় যে বিশৃঙ্খল অর্থনীতিকে শৃঙ্খলায় ফেরানোর পাশাপাশি অর্থনীতিকে বেগবান করতে না পারলে এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে স্বস্তি না দিতে পারলে অনেক বড় অর্জনও মøান হতে বাধ্য।
এটা সত্য যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের আমলে যে জবাবদিহিহীন ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্রই গেড়ে বসেছিলো, সেটাই বর্তমান সংকটকে ঘনীভূত করেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ভেঙে পড়েছিলো, তাতে পাহাড়সম সমস্যার জাল থেকে বেরিয়ে আসা অল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব নয়। অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান এ ক্ষেত্রে যথার্থই বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।’ কিন্তু পুরোনো ব্যবস্থা কিংবা পুরোনো পথের সঙ্গে ছেদ ঘটিয়ে নতুন শুরু তো করতে হবে। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী নেতৃত্বের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে আর্থিক খাত পুরোপুরি রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালিত হয়েছিলো। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছিলো, যারা তাদের গোষ্ঠীস্বার্থে সামষ্টিক স্বার্থকে পুরোপুরি জলাঞ্জলি দিয়েছিলো। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের শক্তিশালী চক্র ভাঙতে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে প্রশ্ন তুলেছেন।
এ প্রশ্ন করাটা যথার্থ; কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সিদ্ধান্ত ও কাজে আমলাতন্ত্রের প্রভাব দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ছে। অথচ হাসিনা সরকারের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার অন্যতম দায় ছিল আমলাতন্ত্রের। আমলাতন্ত্রকে কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে তুলনা করে শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমলাতন্ত্রে পরিবর্তন না হলে বাকি আর পরিবর্তন সম্ভব নয়। অর্থনীতিকে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে বিশাল জন-আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে, সেখানে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মৌলিক প্রশ্নগুলোয় ঐকমত্য জরুরি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে একধরনের বিরোধ দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের পরিবেশ সামগ্রিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একধরনের উদ্বেগও তৈরি করছে, যেটা জন-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সহায়ক নয়। শ্বেতপত্র কমিটির সম্মেলনে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি ঋণখেলাপিদের মনোনয়ন দেবে না। এটিকে স্বাগত জানিয়েই বলতে হয়, গণ-অভ্যুত্থানের বৃহত্তর আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সুস্পষ্ট অঙ্গীকার প্রয়োজন। শ্বেতপত্র কমিটির সিম্পোজিয়ামে যেসব পর্যালোচনা উঠে এসেছে, তার গুরুত্ব অন্তর্বর্তী সরকারকে উপলব্ধি করা জরুরি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকারকে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা কাটিয়ে নাগরিক ও অংশীজনদের শক্তির ওপর তাদের নির্ভরশীল হতে হবে। ভ্যাট বাড়ানোর মতো সহজ সমাধানের পথে না গিয়ে সংকট উত্তরণে ছাত্রনেতৃত্ব, রাজনীতিবিদ, বৃহত্তর ব্যবসায়ী সমাজ, নাগরিক সমাজসহ অংশীজনদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কেননা, গণ-অভ্যুত্থানের জন-আকাক্সক্ষা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সৃজনশীলতা ও গতিশীলতার দাবি তৈরি করে দিয়েছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
চুয়াডাঙ্গা জামায়াতের জেলা মাসিক কর্মপরিষদ সভায় জেলা আমির রুহুল আমিন
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.