বাংলাদেশে গণতন্ত্র এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পর একটি বন্দোবস্ত হয়েছিল। এরপর হাঁটি হাঁটি পাপা করে কিছুটা পথ অতিক্রম করে আবার স্বৈরাচার আমলের চেয়ে আরো মন্দ অবস্থায় পৌঁছে গেছি। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে গণতন্ত্র ও মানুষের মতের মূল্য এখন নেই। উপরন্তু মানুষের ভোট দেয়ার অধিকারও খর্ব হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর কিছু ভুল ত্রুটি থাকলেও অন্তত ভোটের অধিকার মানুষ চর্চা করতে পারছিল। ২০১৪ সালের পর তা-ও উধাও। এ অবস্থায় গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকরা বাংলাদেশ নিয়ে তাদের সতর্কতা প্রকাশ করছেন। তারা চাচ্ছেন, প্রথমে অন্তত এ দেশের মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ ফিরে পাক। সে জন্য পশ্চিমারা অব্যাহতভাবে সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করছে। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কাউন্সিলর ডেরেক শোলে সরকারের উচ্চ মহলের সাথে আলোচনায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে জোর দিয়েছেন। এক আলোচনায় শোলে উল্লেখ করেন, বিশ্বের শক্তিশালী গণতন্ত্রের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পর্ক। তবে বিশ্বের যেকোনো দেশে গণতন্ত্র সঙ্কুচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রও সম্পর্ক সীমিত করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অনুদান দেয়। এ দেশে বড় বিনিয়োগকারী ও সবচেয়ে বেশি পোশাক আমাদের দেশ থেকে আমদানি করে। প্রবাসী আয়ের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রথম অবস্থানে। এ অবস্থায় দেশটির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলেও উল্লেখ করেছেন দেশটির প্রতিনিধিরা।
গত বৃহস্পতিবার একইভাবে ইইউ প্রতিনিধিদল আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনায় অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায় বলে জানিয়েছে। নির্বাচনে আবার পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও বৈঠকে জানিয়েছে। এ জন্য ইতোমধ্যে বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে ইইউ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈঠক শেষে জানিয়েছেন, ইইউ চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করুক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে ইইউ কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। এবার বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছে সংস্থাটি। ২৭টি ইউরোপীয় দেশের সমন্বয়ে গঠিত ইইউর সদর দফতর ব্রাসেলসে। যুক্তরাষ্ট্রের পরই বাংলাদেশের সাথে সবচেয়ে জোরালো অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে ইইউর। ইউরোপ আমাদের পোশাক রাফতানির প্রধান বাজার। অনুদান দেয়াসহ আমাদের অর্থনীতিতে এদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমারা এবার অংশগ্রহণমূলক একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়ে শুধু চুপচাপ বসে থাকবে না; দেশগুলোর তৎপরতা দেখে তা সহজে অনুমেয়। গত বছরের শেষদিক থেকে দেখা যাচ্ছে এসব দেশের সাথে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশও সোচ্চার। তারা সরকারের কাছে এখন থেকে আহ্বান জানাচ্ছে কী পদক্ষেপ নিতে হবে। ইইউর সাথে আওয়ামী লীগের বৈঠকে তারা জানতে চেয়েছে, বিরোধী দলগুলোর আস্থা অর্জনে এ পর্যন্ত সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তরে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরের মতো সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠান ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মানুষ নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনেও তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। সেটি যে বহির্বিশ্ব জানে না, এমন ভাবা বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে তা সবাই জানে। নিশিরাতে নির্বাচন, ভোটের আগের দিন নির্বাচন কিংবা প্রার্থী ও সমর্থকদের এলাকা ছাড়া করে একচেটিয়া নির্বাচন করে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের বিজয়ী করানো কোনোভাবে স্থায়ীভাবে চলতে পারে না। সরকার যদি মনে করে কারচুপি ও জালিয়াতি করে সবসময় পার পাওয়া যাবে; তা হবে ভুল। এর পরও সরকার অনমনীয়তা দেখালে সেটি কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।
আমরা মনে করি, দেশের স্বার্থে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা নেয়া উচিত। বহির্বিশ্বের কে কী বলল সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়; আমাদের নিজেদের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য এমনটি দরকার। ভোট ব্যবস্থাকে ঠিক না করে কোনোভাবে আমরা গণতন্ত্রের চর্চা এবং বিকাশ ঘটাতে পারবো না।