প্রতিদিনই নতুন রেকর্ড : করোনায় লাগামহীন মৃত্যু-আক্রান্ত

আইসিইউ ও সাধারণ শয্যার তীব্র সঙ্কট : হাসপাতালে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়
স্টাফ রিপোর্টার: ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে দেশের করোনা সংক্রমণ। লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিনই হচ্ছে নতুন রেকর্ড। এ পর্যন্ত মৃত্যু ছাড়িয়েছে সাড়ে নয় হাজার। আর আক্রান্ত সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে পাঁচ শতাধিক করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু এবং একই সময়ে শনাক্ত হয়েছে প্রায় অর্ধলাখ। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ৭৪ জনের। একই সময়ে ৭ হাজার ৮৫৪ জন নতুন রোগী শনাক্তের খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সব মিলিয়ে করোনার গোটা পরিস্থিতি একরকম লাগামহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পৌঁছায় মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। হাসপাতালগুলো রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। অক্সিজেন ও আইসিইউ সংকটে শ্বাসকষ্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরেও শয্যা পাচ্ছে না। অনেক রোগী আইসিইউ না পেয়ে হাসপাতালে কিংবা অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যাচ্ছেন। চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে চোখের সামনে স্বজনদের মৃত্যুর দৃশ্য দেখতে হচ্ছে অনেককে। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি হাসপাতালগুলোও করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ হিসাবে রাজধানীতে কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট সাধারণ শয্যা আছে তিন হাজার ৬২২ এর মধ্যে খালি আছে ৪৩২টি। আইসিইউ শয্যা আছে ৩০৫টি। এরমধ্যে মাত্র ১৩টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা আছে। তবে সাধারণ রোগীদের অভিযোগ- সরকারি হিসাবে খালি দেখালেও বাস্তবে সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা পাওয়া যেন ‘সোনার হরিণ’। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাওয়া বিষয়টি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজেই তা স্বীকার করেছেন। বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আমরা কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করেছি। আগে দিনে দেড়শ পরীক্ষা হতো, এখন ৩৫ হাজার পরীক্ষা হচ্ছে। কোভিড রোগীদের সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ শয্যা বাড়ানো হয়েছে। তারপরেও কোভিড নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কোভিডের কারণে নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আগামীতে এই দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রধানমন্ত্রীর ১৮ নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। তাহলে কোভিডকে তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো। শুধু চিকিৎসা নয়, নমুনা পরীক্ষা করাতেও মানুষের ভোগান্তির অন্ত নেই। প্রতিদিন সকাল থেকে হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষার জন্য লম্বা লাইন দেখা যায়। তীব্র গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে পরীক্ষা করাতে না পেরে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। কেউ কেউ কয়েকদিন এসেও পরীক্ষা করাতে পারছেন না। হঠাৎ করে পরীক্ষার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনীয় কিট ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে তারাও অতিরিক্ত পরীক্ষা করাতে পারছেন না। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পরীক্ষা করাচ্ছেন।
করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা তীব্র হওয়ার পেছনের মূল কারণ হচ্ছে সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা-এমনটি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সামাজিক দূরত্ব না মানা, নিয়মিত হাত না ধোয়া, বেশি বেশি পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা না থাকা এবং মাস্ক না পরার কারণেই মূলত এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতেই সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই সিটি করপোরেশন এলাকায় চালু হয়েছে গণপরিবহণ। আজ থেকে খুলবে শপিংমল ও বিপণিবিতান। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি আরও কঠোরভাবে মানতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুসতাক হোসেন বলেন, করোনা সংক্রমণ আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে হাসপাতালগুলো চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। রোগী ও স্বজনদের চরম ভোগান্তি ও কষ্ট হচ্ছে। সংক্রমণের এ ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলেও সামনে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। তাই এখন থেকেই আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। ব্যক্তি সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারের একার পক্ষে তা সম্ভব নয়। সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে সবকিছু বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। তাই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালনের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবিকাও চালিয়ে নিতে হবে।
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, একদিনে মৃত্যুর রেকর্ড হলেও টানা ৪ দিন পর শনাক্ত সাত হাজারের নিচে নেমেছে। কমেছে শনাক্তের হারও। ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৭৪ জনের। এনিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে ৯ হাজার ৫২১ জনের মৃত্যু হলো। একদিনে নতুন করে আরও ৬ হাজার ৮৫৪ জন করোনা শনাক্ত হয়েছেন। সবমিলিয়ে করোনাভাইরাসে শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে ৬ লাখ ৬৬ হাজার ১৩২ জন হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় দেশে সুস্থ হয়েছেন ৩ হাজার ৩৯১ জন। এ নিয়ে সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৩০ জনে। বাংলাদেশে গত বছর ৮ মার্চ করোনাভাইরাসের প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যু হয়। এ বছর ৩১ মার্চ তা নয় হাজার ছাড়িয়ে যায়। মঙ্গলবার এক দিনে ৬৬ জনের মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। বৃহস্পতিবার সেই রেকর্ড ভেঙে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৭৪ জন হয়। সংক্রমণ ধরা পড়ার এক বছর পর এ বছর মার্চের শেষে প্রথমবারের মতো দেশে এক দিনে পাঁচ হাজারের বেশি রোগী শনাক্তের খবর আসে। এর মধ্য দিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২৯ মার্চ ছয় লাখ ছাড়িয়ে যায়। এরপর মাত্র এক সপ্তাহে সেই তালিকায় যোগ হয়েছে আরও অর্ধলাখ রোগী। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বুধবার দেশে রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্তের খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে পরের দিনই তা প্রায় হাজারখানেক কমল। এতে আরও বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২৪৩টি ল্যাবে ৩৩ হাজার ১৯৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৪৯ লাখ ১৫ হাজার ৭৫৮টি নমুনা। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৬ লাখ ৮৫ হাজার ৭০০টি। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হয়েছে ১২ লাখ ৩০ হাজার ৫৮টি। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৪ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এক দিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৪৮ জন পুরুষ আর নারী ২৬ জন। তাদের মধ্যে চারজন বাড়িতে এবং বাকিরা হাসপাতালে মারা যায়। মৃতদের মধ্যে ৪৬ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ১৬ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছর, ছয়জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, পাঁচজনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছর এবং একজনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছিলো। মৃতদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৪৩ জন, চট্টগ্রামের ১৫ জন, রাজশাহীর তিনজন, খুলনার সাতজন, বরিশালের চারজন ও সিলেট বিভাগের দুজন ছিলেন। করোনাভাইরাসে দেশে মৃত ৯ হাজার ৫২১ জনের মধ্যে ৭ হাজার ১৩০ পুরুষ ও ২ হাজার ৩৯১ জন নারী।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More