হেলিকপ্টারে সালিসে এসে জনরোষের মুখে আসক কর্মকর্তারা
জীবননগরের আন্দুলবাড়িয়ায় পিতা-পুত্রের সম্পদ-সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ
জীবননগর ব্যুরো/আন্দুলবাড়িয়া প্রতিনিধি: হেলিকপ্টারযোগে বিবাদীর বক্তব্য শুনতে এসে খানেকটা হাস্যরসের খোরাক হলেন আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশনের ঢাকা বিভাগীয় প্রধান মুহম্মদ লোকমান হোসেন সাঈদীসহ তার সাথে থাকা কয়েকজন। গতকাল শনিবার চুয়াডাঙ্গা জীবননগরের আন্দুলবাড়িয়ায় ঢাকা থেকে তারা হেলিকপ্টরযোগে নামার পরপরই উপস্থিত সংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়ে পুর্বনির্ধারিত স্থানে পৌঁছুনোর বিষয়টিও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। পরে অবশ্য আন্দুলবাড়িয়ার আব্দুল লতিফ বিশ^াসের বাড়ি সংলগ্ন অফিস গোডাউনে পৌঁছে আপস মীমাংসার জন্য এসেছেন বলে জানান।
নোটিশে উল্লেখ করা বক্তব্যের সাথে অভিযোগকারীর বক্তব্যের অমিল উঠে আসতেই ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিদল যুক্তির উক্তি খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খেতে থাকেন। উত্তেজনাও দানা বাধে। আন্দুলবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম মোক্তারের সভাপতিত্ব করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। জীবননগর থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, উথলী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান, চুয়াডাঙ্গা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি জেলা লোকমোর্চর সভাপতি অ্যাড. আলমগীর হোসেন, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব সভাপতি সরদার আল আমিন, সাধারণ সম্পাদক রাজীব হাসান কচি, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক, সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম সনিসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আন্দুলবাড়িয়ার আব্দুল লতিফ ও তার প্রথমপক্ষের তিনপুত্র মোস্তফা আমজাদ, মোস্তফা শাকিল ও মোস্তফা তাজওয়ারের বিরোধ এবং মীমাংসার বিষয়ে বিশদ বর্ণনা করেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে এবং সড়ক পথে বিশাল বহর নিয়ে এসে এই বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগের যথার্ততা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকসহ স্থানীয়রা। এক পর্যায়ে ফাউন্ডেশনের তরফে বলা হয়, ‘স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পিতা-পুত্র তথা পারিবারিক এ বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগই উত্তম। স্থানীয়রাই নিষ্পত্তি করুক।’
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলাধীন আন্দুলবাড়িয়া বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ বিশ^াস। তিনি দেড় শতাধিক ট্রাক, বেশ কয়েকটি ইটভাটার মালিকসহ বহুমুখী ব্যবসায়ী। বহু সম্পদ সম্পত্তিও রয়েছে তার। ২০-২২ বছর আগে তিনি প্রথম স্ত্রী রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। একইবাড়িতে দু’স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। কিছুদিন ধরে প্রথম স্ত্রীর তিন ছেলের সাথে পিত আব্দুল লতিফ বিশ^াসের বিরোধ দানা বাঁধে। ওই বাড়িতে থাকার পরিবেশ নেই বলেও অভিযোগ তোলেন ছেলেরা। বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কয়েক দফা বৈঠকের পর গত ১১ অক্টোবর চুক্তিনামায় সম্মত হয়ে উভয়পক্ষ স্বাক্ষর করে। ছেলেদের ৩০টি ট্রাকসহ কয়েকটি ব্যবসার কর্তৃত্বও লতিফ বিশ^াস দেন। ওই চুক্তিপত্র মোতাবেকই উভয়পক্ষ চলছিলো। মাঝে পিতার বন্ধুর ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ বড় ছেলে মোস্তফা আমজাদকে গ্রেফতারও করে। এরপর ছোট ছেলে মোস্তফা তাজওয়ার ও তার মা আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশনে আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে বিবাদীর বক্তব্য শোনার জন্য দিন ও স্থান নির্ধারণ করে আব্দুল লতিফকে নোটিশ দেয়া হয়। গত দু’দিন ধরে এলাকায় খবর রটে হেলিকপ্টারে চেপে ঢাকা থেকে বড় বড় কর্তারা ঘটনাস্থলে আসছেন। ঢাকা থেকে আসছেন কয়েকজন সাংবাদিকও। চুয়াডাঙ্গার কয়েকজন সাংবাদিককেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। এসব খবর পেয়ে উৎসুক জনতা গতকাল সকাল থেকেই আন্দুলবাড়িয়া ফিল্ডে ভিড় জমান। আব্দুল লতিফ বিশ^াসের বাড়ি সংলগ্ন অফিসেও ভিড় জমে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে ছেলেদের সাথে বিরোধ এবং বিরোধ নিষ্পত্তির বিস্তারিত বর্ণনা করেন আব্দুল লতিফ বিশ^াস। লোকমান হোসেন সাঈদীকে স্বাগত জানাতে গাড়ি বহরও সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। সাজোয়াভাবে থাকে দমকল বাহিনী। সংশ্লিষ্টদের অনুমতি না নিয়ে গাড়িতে সংবাদ মাধ্যমের বড় বড় সাইনবোর্ড লাগানো কেন? প্রশ্ন উঠলে তা তুলে নেয়া হয়। এরই এক পর্যায়ে দুপুরে হেলিকপ্টার অবতরণ করে। আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশনের ঢাকা জোনের সহকারী বিভাগীয় প্রধানসহ ৪জন দুপুর ১২টার পরপরই হেলিকপ্টারে উড়ে এসে আন্দুলবাড়িয়া বিদ্যালয়মাঠে নামেন। দলনেতা লোকমান হোসেন সাঈদী নিজেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার অধীন আইন সহায়তা কেন্দ্র ফাউন্ডেশনের ঢাকা বিভাগীয় প্রধান বলে পরিচয় দেন। বাকি তিনজনের মধ্যে কেএম আবদুল মোমেন সিরাজী নিজেকে বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডের উপস্থাপক, মাসুম বিল্লাহ আইন সহায়তা কেন্দ্র ফাউন্ডেশনের সহকারী প্রধান ও আলতাফ হোসেন অতিরিক্ত বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পরিচয় দেন।
হেলিকপ্টারের পাশে প্রথমেই প্রশ্ন করা হয়, এ ধরনের সালিসের জন্য এর আগেও কি হেলিকপ্টারে করে কোথাও গেছেন? হেলিকিপ্টরের অতো টাকার ভাড়াই বা কে দিলেন? একবার বলা হয়, আমাদের ব্যস্ততার কারণে এখানে হেলিকপ্টর নিয়ে আসতে হয়েছে। একবার বলেন, আমাদের সংগঠনে অনেক শিল্পপতি আছেন তারাই দিয়েছেন, একবার বলেন সংগঠনের তহবিল থেকেই এর ভাড়া দেয়া হয়েছে। একেক সময় একেক জবাবে স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে হাস্যরসের খোরাক জন্মায়। এরপর ঢাকার প্রতিনিধিদল স্থানীয় একটি মার্কেটের ওপর অবস্থান নেয়। পরে অবশ্য আব্দুল লতিফ বিশ^াসের বাড়ি সংলগ্ন কার্যালয়ে পৌঁছান। নোটিশ ও অভিযোগের মধ্যে অসঙ্গতি কেন? প্রশ্ন তুলে অ্যাড. আলমগীর হোসেন বলেন, অভিযোগকারী তার অভিযোগের কোথাও বলেননি অনুমাতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, তাহলে নোটিশে তা এলো কেন? তাছাড়া ২০-২২ বছর আগের বিয়ে। স্থানীয়ভাবে আপস মীমাংসাও হয়েছে। এসব আমলে না নিয়ে অতো দূর থেকে অতো টাকা খরচ করে বিশাল বহর নিয়ে আসার হেতুও আমাদের কাছে রহস্যজনক। ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম মোক্তারও চরম সমালোচনা করেন আগতদের।
এলাকাবাসীর মাঝে কৌতূহল ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মানবাধিকার সংস্থার নেতৃবৃন্দ পরিদর্শনকালে উথলী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান বলেন, পিতা ছেলের পারিবারিক বিরোধ সৃষ্টি হলে এলাকার জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের একজন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে নানা শর্ত সাপেক্ষ চুক্তিনামার মাধ্যমে আপস নিষ্পত্তি করা হয়। সন্তোষজনক সমাধানের পর তাদের পারিবারিক শান্তি স্থাপন করা হয়। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, আবার পিতা ও ছেলের কী এমন বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে যা এলাকাবাসীর কাছে নয়, একটি মানবাধিকার সংস্থার নিকট অভিযোগ দায়ের করতে হবে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যখন শান্তি স্থাপন করে দিয়েছি, প্রয়োজন হলে আমরা আবার ম্যাকানিজম করে উভয়পক্ষকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে শান্তি স্থাপন করতে বদ্ধপরিকর। অবশেষে সাংবাদিক-জনতার তোপের মুখে কথিত মানবাধিকার সংস্থার নেতৃবৃন্দ স্থান ত্যাগ করে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন।
জীবননগর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সামান্য একটি বিষয় নিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে আইন সহায়তা কেন্দ্রের নামে এখানে আসা ঠিক হয়নি। পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু পুলিশের তৎপরতায় সেটা হয়নি।’
সূত্র জানায়, গত ১৯ ডিসেম্বর আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের ব্যবসায়ী অংশীদার দলিল লেখক আহাদ আলী ম-লের ওপর হামলা ও ২০ ডিসেম্বর লতিফ ট্রেডার্সে হামলা ও ভাঙচুর করার ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে আলাউদ্দিন ম-ল বাদী হয়ে জীবননগর থানায় মোস্তফা আমজাদ তার সহোদর মোস্তফা শাকিল ও মোস্তফা তাজওয়ারসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় পুলিশ মোস্তফা আমজাদকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করে। এ হামলা মামলায় ছেলেরা জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করছেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফের পিতা ও ছেলেদের মধ্যে বিরোধটি তুঙ্গে উঠে উভয়পক্ষের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে।