আলমডাঙ্গার রায়সার দিনমজুর ইউসুফের মৃত্যুর নেপথ্যে স্ত্রীর পরকীয়া নাকি অন্যকিছু?
স্টাফ রিপোর্টার: আলমডাঙ্গার রায়সা শানবাধাপাড়ার ইউসুফ ম-লের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। থানা পুলিশ মামলা নিতে গড়িমশি করায় হত্যার অভিযোগ তুলে আদালতে মামলা দায়ের করেন তার মা হালিমা খাতুন। পুত্রবধূর পরকীয়ার কারণে কবিরাজি ওষুধের মাধ্যমে ইউসুফকে হত্যা করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে ইউসুফের স্ত্রী তাসলিমা খাতুন, তার পরকীয়া প্রেমিক নওলামারী গ্রামের মহর আলীর ছেলে হাসিবুল ইসলাম (৪০), শিশিরদাড়ি গ্রামের উম্বাদ আলীর ছেলে কবিরাজ আব্দুল খালেক (৫৫) ও তাসলিমার বোনের ছেলে আল-আমীনকে (২৩)।
এদিকে, নিহত ইউসুফের মা মামলার বাদী হালিমা খাতুন অভিযোগ করে বলেন, আমার ছেলের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানোর পর থেকে হাসিবুল দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছে। জায়গা-জমি বিক্রি করে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও জানান তিনি। এতে অসহায় হালিমা খাতুন একমাত্র ছেলে হত্যার সঠিক বিচার না পাওয়ার আশায় ভুগছেন। ছেলে ইউসুফ হত্যায় অভিযুক্ত আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে সঠিক বিচারের দাবি অসহায় হালিমা খাতুনের। তিনি আরও বলেন, মামলায় হাসিবুলের নাম থাকায় বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে করে ইউসুফের মৃত্যুটা স্বাভাবিক করণে হয়েছে এটা প্রমাণ করতে। তিনি আরো বলেন, হাসিবুলের কথা মতো বিভিন্ন কবিরাজি ওষুধ খালেককে কিনতে টাকা দিতো আর সেটা আল-আমীন পৌঁছে দিতো তাসলিমার কাছে এবং সেটা রাতে শরবতের মধ্যদিয়ে খাওয়াতো।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাসকররা ইউনিয়নের রায়সা শানবাধাপাড়ার মৃত ইউনুস আলীর ছেলে ইউসুফ ম-ল গত ২৭ অক্টোবর বুধবার রাতে শরীরে প্রচ- জ্বালাপোড়া অনুভব করেন। পরিবারের লোকজন তাকে হাসপাতালে নিতে চাইলে স্ত্রী তাসলিমা খাতুন (৩২) তার মামা শিশিরদাড়ি গ্রামের উম্বাদ ম-লের ছেলে কথিত কবিরাজ আব্দুল খালেকের কাছে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে ইউসুফের গাছ-গাছড়া খাওয়ানোসহ ঝাড়-ফুঁক করেন। এরপর শারীরিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন ইউসুফ। ইউসুফের অবস্থা বেগতিক দেখে কবিরাজ আব্দুল খালেক হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। হাসপাতালে নেয়ার পথেই বলেশ্বরপুর বাজারে ইউসুফের মৃত্যু হয়। সকাল ১০টায় জানাজা শেষে দাফনের সময় বাঁধা দেয় আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ। সে সময় তাৎক্ষণিকভাবে ইউসুফের মায়ের অভিযোগ এবং স্ত্রীর অস্বাভাবিক কথাবার্তায় সন্দেহ হয় পুলিশের। এ সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অনেক চেষ্টা করেও লাশ দাফন করতে পারেননি। অবশেষে ময়নাতদন্তের জন্য নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। এরপর ময়নাতদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় ইউসুফের মরদেহ দাফন করা হয়।
ঘটনাসূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ অক্টোবর শনিবার ঘোষবিলার ইটভাটার কাজ শেষ করে বাড়িতে এসে হঠাৎ ক্লান্তি অনুভব করেন ইউসুফ আলী। স্ত্রী তাসলিমা খাতুন তার মামা আব্দুল খালেকের কাছে নিয়ে গেলে তিনি জানান, ইউসুফকে সাপে কামড় দিয়েছে। সেখানে রেখেই প্রায় ৫-৬ দিন তাকে চিকিৎসা চালান কবিরাজ খালেক। এরপর নিজবাড়িতে চলে আসার পর ইউসুফ আলী শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে শক্তি হারাতে থাকেন এবং অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। গত ২৭ অক্টোবর ঘটনার রাতে ইউসুফ শরীরে জ্বালাপোড়া অনুভব করলে তার মা হালিমা খাতুন স্যালাইন খাওয়াতে যান। ইউসুফের স্ত্রী তাসলিমা খাতুন সেই স্যালাইন পানি ফেলে দিয়ে কবিরাজের দেয়া ওষুধ ইসবগুলের ভূষির সাথে মিশিয়ে খাওয়ান। এর পরপরই ইউসুফের বুক-পিঠ ফেটে যেতে লাগে এবং হাতের শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
ইউসুফের মামাতো ভাই মোস্তাক আহমেদ বলেন, আমার ভাবী তাসলিমা খাতুন মোবাইল সম্পর্কে তেমন না বোঝার কারণে প্রায়ই আমার স্ত্রীর কাছে যেতো। মোবাইল নম্বর দিয়ে ইমোতে ভিডিওকল করে দেয়ার জন্য বলতো। তখন আমার স্ত্রী তাসলিমার নিজের বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে থাকার পরও এসব না করার কথা বললেও কোনো কর্ণপাত করতো সে। মোস্তাক আরও বলেন, কিছুদিন পরই নওলামারী গ্রামের মহর আলীর ছেলে হাসিবুলের সাথে তাসলিমার পরকিয়া সম্পর্কের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এরপরই ইউসুফ ও তাসলিমার মধ্যে কলহের সৃষ্টি হতে থাকে। বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে রাগের ছলে বাবার বাড়িতে গিয়ে হাসিবুলের সাথে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে দেখা যেতো তাসলিমার। এসব জানার পর ইউসুফ বিরোধিতা করায় তাসলিমা তার মামা আব্দুল খালেক কবিরাজের সাথে নিয়ে শুরু করে নতুন চক্রান্ত।
মোস্তাক আরও জানান, ৬ মাস আগে থেকেই ইউসুফকে শরবতের সাথে কবিরাজি ওষুধ খাওয়াতেন স্ত্রী তাসলিমা। এরপর থেকেই তার শারীরিক দুর্বলতা এবং মানসিকতার অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা যায়। এদিকে, দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে তাসলিমা। মাঝেমধ্যেই চিকিৎসার কথা বলে রাজশাহী ও ফরিদপুরে গিয়ে একদিন/দুদিন পর ফিরে আসতো। বিষয়টি নিয়ে ইউসুফ কিছু বললেই শুরু হতো অশান্তি। বেপরোয়া স্ত্রীর সাথে পেরে না ওঠায় ছেলে-মেয়ের কথা চিন্তা করে নিরবেই সব সহ্য করতেন তিনি। এসব ঘটনা মা ও মামাদের সকলেই জানেন। ইউসুফের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হলেও স্ত্রী তাসলিমা ব্যবহার করতেন দামি স্মার্টফোন। এমনকি মেয়েকেও দামি স্মার্টফোন দিয়েছিলেন তাসলিমা। এগুলো সবই প্রবাস ফেরত বর্তমানে ওয়েল্ডিং ব্যবসায়ী হাসিবুল ইসলাম দিয়েছিলেন বলে জানান মোস্তাক।
হাসিবুল ইসলামের দোকানের সাবেক কর্মচারী রায়সা শানবাধাপাড়ার পারভেজ মোবাইল ফোনে জানান, আমি যখন হাসিবুলের দোকানে কাজ করতাম, সেসময় প্রায়ই তার স্ত্রী এসে তাসলিমার সাথে তার স্বামীর পরকীয়ার কারণে সংসার ভেঙে যাচ্ছে বলে কান্নাকাটি করতেন। এমনকি তাসলিমা আর হাসিবুলের একাধিক ফোন রেকর্ডও শোনাতেন। পরে আমি বিষয়টি সমাধানের জন্য ইউসুফের ছোট মামা মনিরুলকে জানায়। পরবর্তীতে কি হয়েছে তা জানি না। তবে তাসলিমার সাথে হাসিবুলের অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক ছিলো।
এ ব্যাপারে হাসিবুল ইসলামকে বাড়িতে না পেয়ে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি কোথায় রয়েছেন জানতে চাইলে হাসিবুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার কারণে হাসপাতালে রয়েছেন। কোন হাসপাতালে? উত্তরে তিনি হাসপাতালের পাশে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রয়েছেন বলে জানান। ইউসুফের স্ত্রী তাসলিমার সাথে তার সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার নম্বর সার্ভারে দেয়া আছে, মোবাইলে কথা বলতে পারবো না’ বলেই কল কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেন।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. এএসএস ফতেহ্ আকরাম জানান, ইউসুফের ময়নাতদন্ত করেছেন হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস। লাশের গায়ে কোন আঘাতের চিহ্ন আছে কি-না সেটা পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করে থানায় পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ভিসেরার নমুনা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পেতে কিছুদিন সময় লাগবে। এখানে কেউ তদবির করে ফলাফল পরিবর্তন করতে পারবে না।