সব বই না দিয়েই দীর্ঘ ছুটি : ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা বিপাকে শিক্ষকরা
সিলেবাস প্রণয়ন করে দেয়া গেলে ঘাটতি পূরণে ইতিবাচক হবে
স্টাফ রিপোর্টার: একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আবু সুফিয়ান। মাত্র দুটি বই পেয়েছে সে। বাংলা ও ইংরেজি। গণিত, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়সহ চারটি বই নেই তার হাতে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সুফিয়ানের স্কুলে ছুটি শুরু হয়েছে, খুলবে ৭ এপ্রিল। অর্থাৎ, ৪০দিনের দীর্ঘ ছুটি। ছুটি শুরুর ঠিক আগের দিন স্কুলে দাঁড়িয়েই কথা হয় সুফিয়ানের মা হোসনে আরার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘স্যাররা তো ছুটিতে অনেক পৃষ্ঠা করে পড়া দিয়েছেন। কিন্তু বই দিয়েছেন মাত্র দুটি। যেসব বই দেননি সেগুলোর পৃষ্ঠা উল্লেখ করে দিয়েছেন। ছুটির মধ্যেই এসব পড়া শেষ করতে বলেন। কিন্তু ছেলেটাকে পড়াবো কীভাবে?’ অপর একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী উম্মে হাফসা জানায়, মাত্র তিনটি বই পেয়েছে তারা। বাকি ১১টি বই পায়নি। কিন্তু সব বই থেকে কয়েক অধ্যায় করে ছুটিতে পড়া শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন শিক্ষকরা। যে বই হাতেই নেই, তা থেকে পড়বে কীভাবে-প্রশ্ন হাফসার। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুফিয়ানের মা হোসনে আরা ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী হাফসার প্রশ্নের জবাব নেই শিক্ষকদের কাছেও। শিক্ষকরা বলছেন, এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে যেটুকু পড়া শেষ করা দরকার, সেটুকু তারা পড়তে দিয়েছেন। বই নেই এটা শিক্ষা প্রশাসন তথা সরকার দেখবে। শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী অধ্যায় শেষ করার তাদের দায়িত্ব। শুধু এ দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, সারাদেশের প্রাথমিকের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নামমাত্র দু-তিনটি করে বই দেয়া হয়েছে। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও এখনো সব বই পায়নি। প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও অনেকে বই পায়নি। শুধু দশম শ্রেণির শতভাগ শিক্ষার্থী ছুটির আগে বই হাতে পেয়েছে। শিক্ষক-অভিভাবকরা বলছেন, পাঠ্যবই ছাড়াই দীর্ঘ ছুটিতে থাকা শিক্ষার্থীরা বড় শিখন ঘাটতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। বছরের প্রথম দু-তিন মাস ভালো ক্লাস না হলে পরবর্তীসময়ে সংকট আরও বাড়বে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও স্কুল বন্ধ রাখতে হয়। ফলে ছুটির মধ্যে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ঠিক রাখতে বিশেষ নির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন ছিলো, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকার করেনি। বই নেই, সেখানে ছুটি কমিয়ে স্কুল খোলা রেখে লাভ নেই বলে মনে করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। উল্টো এতে সমালোচনা বাড়তে পারে বলেও ধারণা তাদের। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষাপঞ্জিতে পরিবর্তন এনে মৌলিক বিষয়গুলো রেখে বিশেষ ২ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তথ্যমতে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাধ্যমিকের ৬৬ শতাংশ বই ছাড়পত্র পেয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অনেক বই শিক্ষার্থীরা হাতে পেয়েছে। কিছু বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার কাজ চলমান। বাকি ৩৪ শতাংশ বই ছাপার কাজ চলছে। সবমিলিয়ে মাধ্যমিকের এখনো প্রায় ছয় কোটি বই ছাপানো বাকি। এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রণ শাখা সূত্র জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণির মোট বই ৬ কোটি ৪২ লাখ। তার মধ্যে ছাপা শেষ হয়েছে ৫ কোটি ১৬ লাখ ৩৭ হাজার। সপ্তম শ্রেণির ৪ কোটি ৮১ লাখ বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ৪ কোটি ৬ লাখ ২২ হাজার। অষ্টম শ্রেণির বই ৫ কোটি ২০ লাখ ৬৮ হাজার বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ২ কোটি ৯৬ লাখ। নবমের ৬ কোটি ১২ লাখ বইয়ের মধ্যে ছাপা শেষ হয়েছে মাত্র ২ কোটি ২০ লাখ ১৮ হাজার কপি। বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান বলেন, যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে কাজ নামাতে পারিনি। কিছু ছোট ছোট প্রেস বইয়ের কাজ নিয়ে ঝামেলা করছে। অনেকে এখন কাজ করতেই পারছে না। সক্ষমতা দেখিয়ে তখন কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। এখন নানা সংকট দেখাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হবে।’ প্রাথমিকের বই ছাপা-বিতরণ তদারকি করে এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ শাখা। এ শাখার কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ৪ কোটি ৩৮ লাখ বইয়ের মধ্যে ৪ কোটি ৩৪ লাখ বই ছাপা শেষ। চতুর্থ ও পঞ্চমে ৪ কোটি ৩ লাখ ৬৬ হাজারের মধ্যে ৩ কোটি ৭৯ লাখ বই ছাপা হয়েছে। উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু বলেন, ‘প্রাথমিকের বই ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শেষ করতে পারতাম। দু-তিনটি প্রেসের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ২০-২১ লাখ বই ছাপা বাকি রয়েছে। আশা করি, দ্রুত সেগুলো স্কুলে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে।’ এক শ্রেণি শিক্ষক বলেন, রোজা-ঈদের লম্বা ছুটির আগে সব বই না দেয়ায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। তাদের অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকার পাঠ্যবই নিয়ে শুরুতে যে গাফিলতি করেছে, সে কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষা নিয়ে এ সরকারের উদাসীনতাও দেখছেন তারা। পড়ালেখা নিয়ে এবার খুব এলোমেলো অবস্থা। বই না থাকলে শিক্ষার্থীদের পড়ানো খুবই কষ্টসাধ্য। তাদের ওপর চাপ দেয়া যায় না। ক্লাসে মনোযোগীও করা যায় না। এটা শিক্ষকদের পাঠদানের ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতা।
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মা লাবনী আক্তার বলেন, জানুয়ারিতে বই দেয়া যায়নি, দেশের সমস্যা চলছে সেটা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস চলে গেলো, তাও বই দেয়া গেলো না এটা মানা যায় না। এখন রোজার ছুটি, ঈদের ছুটি, এসএসসি পরীক্ষার ছুটি। বছরের অর্ধেক সময় তো পার হয়ে যাবে। বই হাতে পেয়ে তিন-চার মাসও লেখাপড়া করার সময় পাচ্ছে না বাচ্চারা। এ গ্যাপ কীভাবে পূরণ করা হবে, তা নিয়েও কোনো আলাপ-আলোচনা নেই। তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজটা কী? নবম শ্রেণির ছাত্রী সুমতী রানীর বাবা সাধন সরকার বলেন, ‘বই নেই। ক্লাসও হচ্ছে না। এখন আবার ছুটি। তাও এক-দুই সপ্তাহ নয়, দেড় মাসের বেশি। ক্লাস নাইন এভাবে পার হয়ে গেলে এক বছর পড়ে এসএসসি পরীক্ষা দিতে হবে মেয়েটার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটিতে পড়ালেখার জন্য বিশেষ কোনো নির্দেশনা বা পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’ পাঠ্যবই শেষ করতে ছুটিতে পড়া দিলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন খোদ শিক্ষকরা। তারা বলছেন, শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী অক্টোবরের মধ্যে বই শেষ করতে হলে যেটুকু এপ্রিলের মধ্যে পড়ানো দরকার সেটুকু পড়া তা দিয়েছেন। কিন্তু সেটা শিক্ষার্থীরা পড়তে পারবে না বলে মনে করেন তারা।
শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণিতে আমি বিজ্ঞানের ক্লাস নিই। যে দুই শাখায় আমি ক্লাস নিচ্ছি, সেখানে কেউ বিজ্ঞান বই পায়নি। অনলাইন থেকে কেউ কেউ ডাউনলোড দিয়েছে। কেউ পুরোনো বই এনেছে। পাঠের ধরন ও প্রশ্নের পদ্ধতি এবং শিক্ষাক্রম পাল্টে যাওয়ায় নতুন বই অনুশীলন দরকার। ওদের হাতে বই নেই। কীভাবে বুঝিয়ে দেবো, কীভাবে ওরা ছুটিতে পড়বে, আমি নিজেই কনফিউজড।’ ঝিনাইদহ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির একটি শাখার শ্রেণি শিক্ষক সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পড়ালেখা নিয়ে এবার খুব এলোমেলো অবস্থা। বই না থাকলে শিক্ষার্থীদের পড়ানো খুবই কষ্টসাধ্য। তাদের ওপর চাপ দেয়া যায় না। ক্লাসে মনোযোগীও করা যায় না। এটা শিক্ষকদের পাঠদানের ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতা।’ বিগত কয়েক বছর বন্যা-শৈত্যপ্রবাহের কারণে ক্লাস বন্ধ রাখায় শিখন ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। ঘাটতি পোষাতে রমজানেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। তাতে অনেকের আপত্তি থাকলেও অনেকে সেটিকে যৌক্তিক বলে মত দিয়েছিলেন। এবার বই হাতে পেতে দেরি হওয়ায় রমজানের ১৫-২০ তারিখ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে ক্লাস নেয়ার দাবি তুলেছিলো অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। তাদের সেই দাবি নিয়ে কোনো আলোচনায় করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এমনকি বই ছাড়া ছুটিতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে পড়বে, তা নিয়েও মাউশি, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো মাথাব্যথা নেই। অভিভাবক মো. জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আমরা মাউশির ডিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ২০ রমজান পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার দাবি জানিয়েছিলাম। তাতে শিক্ষাপ্রশাসন কোনো সাড়া দেয়নি। যৌক্তিক এ দাবি নিয়ে তারা আলোচনাও করেছে বলে মনে হয়নি। তাদের এমন অবস্থানে প্রতীয়মান হয় যে, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই।’ বিষয়টি নিয়ে মাউশির মাধ্যমিক শাখার সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ছুটিতে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখা নিয়ে বিশেষ নির্দেশনার একটি আলোচনা আমরা তুলেছিলাম। কিন্তু মাউশির ডিজি পদ নিয়ে টানাপোড়েন চলায় তা এজেন্ডায় আর থাকেনি। তাছাড়া যেহেতু শিক্ষার্থীদের হাতে বই নেই, তাই স্কুল খোলা রেখেও লাভ নেই বলে মনে করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জানতে চাইলে মাউশির মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, ‘শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী ছুটি শুরু হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ছুটি কমানো-বাড়ানো নিয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। সেজন্য আমরাও এ নিয়ে কোনো নির্দেশনা দেইনি। পুরো ছুটি শেষে স্কুল-কলেজ খুলবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিশেষ পরিস্থিতি বা যে কোনো কারণে এবার পাঠ্যবই উপযুক্ত সময়ে দেয়াটা সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে শিক্ষাপঞ্জিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিশেষ সিলেবাস করা উচিত। যে সিলেবাস অনুসারে পড়ানো হলে মৌলিক বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের পাঠ্য থেকে কোনোভাবেই বাদ যাবে না। এজন্য কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা দ্রুত কাজ করে বিশেষ সিলেবাস প্রণয়ন করতে পারেন। সেটা ছুটির পরপরই স্কুলে স্কুলে পৌঁছে দিলে ঘাটতি পূরণে কার্যকর প্রভাব পড়বে বলে বিশ্বাস করি।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.