শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেই দুঃসংবাদ দিলো আবহাওয়া অফিস
স্টাফ রিপোর্টার: একদিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি কমে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। সূর্যের দেখা না মেলায় ঘন কুয়াশা বৃষ্টির মতো ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে এবং হিমেল বাতাস বয়ে যাওয়ার কারণে তীব্র শীতের অনুভূতি স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত করে দিচ্ছে। কনকনে ঠা-া আর তীব্র শীতে কাঁপছে প্রাণিকুল। সুর্যের দেখা মেলেনি। কুয়াশাচ্ছন্ন রয়েছে চারপাশ। মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে মানুষ। দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে বান্দরবানে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সীতাকু-ে সর্বনিম্ন তাপামত্রা ছিলো ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি, বরিশালে ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি, শ্রীমঙ্গলে ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি, ঈশ^রদীতে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া দেশের অধিকাংশ জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ১৩ দশমিক ১ ডিগ্রি এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো ১৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো টেকনাফে ২৬ দশকি ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দেশজুড়ে বয়ে চলা শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেই বৃষ্টির দুঃসংবাদ দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। দেশের ছয় বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বজ্রসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় আবহাওয়ার সর্বশেষ বুলেটিনে জানানো হয়, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায়; ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের দু-এক জায়গায় বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। বৃষ্টির কারণে শীতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া সংশ্লিষ্টরা। এরইমধ্যে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ চলছে চুয়াডাঙ্গা, মৌলভীবাজার, বগুড়া, নওগাঁ, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, পঞ্চগড় ও বরিশালে। বৃষ্টির কারণে এই তাপমাত্রা আরও কমতে পারে।
আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক জানিয়েছেন, ২০ তারিখের পর কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ কেটে গেলে আবার ঠা-া বাড়তে শুরু করবে, যা এ মাসজুড়ে অব্যাহত থাকবে।
আবাহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, বুধবার রাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। এটি কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগে সাময়িকভাবে বিঘœ ঘটতে পারে।
চুয়াডাঙ্গায় টানা তিন দিনের মৃদু শৈত্যপ্রবাহ শেষে দুই দিন বিরতির পর বুধবার আবারও শুরু হয়েছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। ঘন কুয়াশা আর শৈত্যপ্রবাহে জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না। বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশুরা।
আবহাওয়াবিদেরা জানান, কোনো এলাকায় তাপমাত্রা যদি ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে, তাহলে ওই এলাকার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়। টানা তিন দিন শৈত্যপ্রবাহের পর সোমবার তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, পরদিন মঙ্গলবার দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান বলেন, সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ব্যবধান কমে যাওয়ায় এমন শীত অনুভূত হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান জানান, চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। গতকাল বুধবার চুয়াডাঙ্গার সর্বমিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত কয়েকদিন ধরে শীতের তীব্রতা বাড়ায় শীত থেকে রক্ষা পেতে সাধ্যের মধ্যে পছন্দের পোশাক কিনতে ক্রেতারা ভিড় জমাচ্ছেন শহরের অভিজাত মার্কেটসহ ফুটপাতের দোকানগুলোতে।
চুয়াডাঙ্গার শহরের সমবায় নিউমার্কেট, আব্দুল্লাহসিটি, প্রিন্সপ্লাজা, পুরাতন গলির মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেট এবং ফুটপাত মার্কেটগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, গরম কাপড়ের চাহিদা অনেক বেশি। ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণে হরেক রকম বাহারি পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা।
প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ফুটপাতের দোকানগুলোতে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি উচ্চবিত্তরাও রাস্তার পাশের এসব দোকানে ভিড় জমাচ্ছেন। অভিজাত মার্কেটগুলোতে সোয়েটারের দাম বেশি হলেও ফুটপাতের দোকানে একটি সোয়াটারের দাম ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা, বাচ্চাদের কাপড় ৬০ থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা পর্যন্ত, মাফলার ৫০ থেকে ২০০ টকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সাধ্যের মধ্যে থেকেই পছন্দের শীতের পোশাকটি বেছে নিতে চেষ্টা করছে নিম্নবিত্ত দরিদ্র মানুষরা।
কয়েকজন ক্রেতা জানান, শীত বাড়লেই পরিবারের সবার জন্যে শীতের পোশাক ক্রয় করা লাগে। অভিজাত মার্কেটগুলোতে পোশাকের যে দাম তাতে আমাদের পক্ষে ক্রয় করা সম্ভব হয় না। তাই অল্প টাকায় বেশি পোশাক কিনতে ফুটপাতের দোকানগুলো থেকেই কিনতে হয়। ফুটপাতের কয়েকজন শীতবস্ত্র বিক্রেতা জানান, এখানে সব বয়সী মানুষের পোশাক বিক্রয় হচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছি। শীত বেশি পড়লে ব্যবসা অনেক ভালো হয় এবং শীত কম হলে বেচা কেনা কম হয়। বড়দের জ্যাকেট, সোয়েটার, কোট, বাচ্চাদের কাপড় পাওয়া যায়, সেগুলোর দাম তুলনামূলক একটু কম হয়। কোনো পোশাকের মূল্য নির্দিষ্ট করা থাকে না। দরকশাকশির মাধ্যমে কিনতে হয়। পোশাকের দাম একটু বেশি করে চাওয়া হয়।
এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা কমে আসায় আন্তজেলা ও দূরপাল্লার যানবাহনগুলোকে আজ দিনেও হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। সাধারণত চুয়াডাঙ্গা শহরে সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও ১০টা পর্যন্ত বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ ছিলো।
চুয়াডাঙ্গার পৌর এলাকার সরদারপাড়ায় নর্দমাসংস্কারের কাজ করছিলেন দুই শ্রমিক। দুজনেরই বাড়ি দামুড়হুদা উপজেলার ঝাঁঝাডাঙ্গা গ্রামে। তীব্র শীতের মধ্যে কাদাপানিতে কাজ করতে করতে শ্রমিক আবদুল আলীম বলেন, ‘শীতি মনডা বোলে না বাড়িততি বের হই। সাতসকালে কুয়াশার মদ্দি আলমসাধু চইড়ে চুয়োড্যাঙ্গা আসতি হয়। ঠা-া বাসাতে জমে যায়। আবার কাদাপানির ভেতর কাজ কত্তি গিয়ে পা টালি যায়। প্যাটের জন্নি সপ কষ্টই সহ্য করতি হয়।’
উত্তর থেকে ধেয়ে আসা কনকনে ঠা-া বাতাসে ঠা-াজনিত রোগবালাই বেড়ে চলেছে। জেলার সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রোটাভাইরাস ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, অ্যাজমাসহ শ্বাসকষ্টের রোগ নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী ভর্তি হচ্ছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন। সদর হাসপাতালে ১৩ শয্যার বিপরীতে আজ সকালে ৭৬ শিশুকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাওয়া যায়। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে আরও ৫৮ শিশু ভর্তি আছে।
সদর হাসপাতালের শিশু বিভাগের পরামর্শক মাহবুবুর রহমান বলেন, শীত মরসুমে মায়েদের সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। ছয় মাস পর্যন্ত শিশুদের কেবল বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। প্রয়োজনীয় সব টিকা দিতে হবে। হাতে-পায়ে মোজা ও গরম পোশাক পরাতে হবে। ডায়রিয়া ও ঠান্ডাজনিত কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। মায়েদের যাতে ঠান্ডা না লাগে, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
চুয়াডাঙ্গায় অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল সৈয়দ কামরুজ্জামান দুস্থ শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। গতকাল বুধবার ৫ম দিন বিকেলে ফার্মপাড়া খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা মাঠে দুস্থ শীতার্ত মানুষের মাঝে এ কম্বল বিতরণ করা হয়। ফার্মপাড়া খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা’র বড় হুজুর মাহফুজুর রহমান সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গার কৃতি সন্তান অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল সৈয়দ কামরুজ্জামান বিজিবিএম, এমপিএইচএফ। অনুষ্ঠানে সৈয়দ শরিফুল আলম বিলাস, মফিজুর রহমান মনা, হারু মিয়া, আজিজুল, ফারুক হাসান চান্দু ও আমিনুল ইসলাম লুলু, মিলু ও জাকির হোসেনসহ আরও অনেকে এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, ৫ দিনের মৃদু শৈত্যপ্রবাহের পর একদিন বিরতী দিয়ে আবার গতকাল বুধবার হতে জীবননগরবাসী হাঁড় কাপানো শীতের কবলে পড়েছে। সূর্য ওঠেনি। ঘন কুয়াশায় চাঁদরে ঢাকা ছিলো সারাদিন। ফলে তীব্র শীত অনুভূত হয়েছে সারা দিন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ রাস্তা-ঘাটে খুব একটা বের হয়নি। রাত ৮টার মধ্যেই ব্যস্ত শহর অনেকটা ফাঁকা হয়ে পড়ে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। তীব্র শীতের কারণে শিশু ও বয়স্ক মানুষ শীতজনিত রোগের প্রকোপে পড়েছে। কোল্ড ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও সর্দি-জ¦রসহ অন্যান্য রোগ নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু ও বৃদ্ধ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ভর্তিকৃতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যায় বেশি করে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। গত কয়দিনের তীব্র শীতের কারণে দিন মজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ কাজে যেতে না পেরে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতরভাবে জীবন যাপন করছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.