শিক্ষাঙ্গনে উপসর্গ দেখা দিলে শিক্ষার্থীদের না পাঠানোর আহ্বান
শিক্ষার্থী আক্রান্ত ও একজনের মৃত্যুর খবরে সবারই নড়েছে টনক
শিক্ষার্থী আক্রান্ত ও একজনের মৃত্যুর খবরে সবারই নড়েছে টনক
স্টাফ রিপোর্টার: মাত্র দুইদিনের ব্যবধানে গোপালগঞ্জ, কোটালীপাড়া ও চাঁদপুরে পাঁচ শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় এবং মানিকগঞ্জে এ মরণব্যাধির উপসর্গ নিয়ে এক ছাত্রীর মৃত্যুর পর শিক্ষাঙ্গনে স্বাস্থ্য সতর্কতা আরও বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি এ নিয়ে কেউ যাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে অহেতুক আতঙ্ক ছড়াতে না পারে সে ব্যাপারে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে কোনো শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি করোনার সামান্য উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে তাকে স্কুল-কলেজে না পাঠিয়ে অভিভাবকরা যাতে বিষয়টি তাৎক্ষণিক সংশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অবগত করেন- সে ব্যাপারে দেয়া নির্দেশনা জোরালোভাবে পালন করতে সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনে কোনোভাবে স্বাস্থ্যবিধি যাতে লঙ্ঘন না হয়, তার তদারকিও জোরদার করতে বলা হয়েছে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজ খোলার পর শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি ভালোভাবেই মেনে চলছে। যদিও অসচেতন কিছু অভিভাবক সন্তানদের স্কুল-কলেজ থেকে নিতে গিয়ে মুখে মাস্ক না পরে গেটের সামনে অযথা ভিড় জমিয়ে স্বাস্থ্যবিধি বেশ কিছুটা লঙ্ঘন করেছে। তবে পরবর্তীতে অভিভাবকদের মধ্যে এ প্রবণতা কিছুটা কমলেও স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধীরে ধীরে গা ছাড়া ভাব দেখা গেছে। স্কুল খোলার পর সপ্তাহ ঘুরতেই কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের মধ্যেও এ ব্যাপারে সতর্কতা কমেছে। তবে সম্প্রতি করোনায় কয়েকজন শিক্ষার্থী আক্রান্ত ও একজনের মৃত্যুর খবরে সবারই টনক নড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতো করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে আগের চেয়ে সতর্কতা আরও বাড়িয়েছে।
শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে আড্ডা দেয়া, অযথা ঘুরে বেড়ানো এবং সহপাঠীদের নিয়ে খাওয়া-দাওয়ার বিষয়গুলোও বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে।
শিক্ষক আল-মনসুর জানান, কয়েকজন শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরে অভিভাবকরা অনেকেই উদ্বিগ্ন। অথচ সন্তানরা স্কুল-কলেজ ছুটির পর বাইরে বের হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানছে কি না কিংবা অসচেতনভাবে অযথা ঘোরাঘুরি করছে কি না-অভিভাবকরা তার খোঁজ নিচ্ছেন না। স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের সঙ্গে সরাসরি ও টেলিফোনে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে তাদের সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছে। বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থীর
বিরুদ্ধে শিক্ষাঙ্গনের বাইরে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে আড্ডা দেওয়ার অভিযোগ আছে, তাদের অভিভাবকদের এ ব্যাপারে কঠোর হওয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে চলাফেরা করলে তা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ তাদের নেই। এরপরও তারা এ বিষয়টি তদারকি করার উদ্যোগ নিয়েছে। শিক্ষাঙ্গনের ভেতরে-বাইরে সবখানেই নিয়মিত মাস্ক পরিধানের বিকল্প কিছু নেই, এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের বারবার সচেতন করা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকজন শিক্ষার্থীর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা চক্র যাতে কোনো ধরনের গুজব ছড়াতে না পারে, সে ব্যাপারে তারা সজাগ রয়েছে। এজন্য তারা ফেসবুক ও ইউটিউবসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের অহেতুক আড্ডা বন্ধের ব্যাপারেও তারা কঠোর হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর দুই সপ্তাহে ৬ জন শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। স্কুল-কলেজ খোলা না থাকলেও শিক্ষার্থীরা বাসা-বাড়ি কিংবা অন্য কোথাও গিয়েও করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে সবাইকে আরও সতর্ক হওয়া জরুরি। বিশেষ করে ১৮ বছরের কম বয়সি শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, তাদের যেহেতু এখনো টিকা দেওয়া শুরু হয়নি, তাই তাদের জন্য মাস্ক পরিধান ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করোনা থেকে দূরে থাকতে হবে। যাদের টিকা নেয়ার সুযোগ আছে, ওইসব শিক্ষার্থী যাতে দ্রুত টিকা গ্রহণ করেন তার পরামর্শ দেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
প্রসঙ্গত, গত ২২ সেপ্টেম্বর চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার হাসিমপুরে অবস্থিত ডক্টর মনসুরউদ্দীন মহিলা কলেজের তিন শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে কলেজের অধ্যক্ষ মো. শহীদুল ইসলাম জানান, গত ২০ সেপ্টেম্বর কলেজের ৫০ শিক্ষার্থীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বুধবার তিনজনের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তিন শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্তের রিপোর্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অভিভাবকদের কলেজে ডেকে বিষয়টি জানানো হয় এবং তাদের হোম আইসোলেশন নিশ্চিত করা হয়েছে।
তবে এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই দাবি করেন কলেজ অধ্যক্ষ বলেন, প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মেপে কলেজে প্রবেশ করানো হয়। কারও শরীরে তাপমাত্রা একটু বেশি হলেই করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এদিকে গোপালগঞ্জ সদর ও কোটালীপাড়ায় দুই শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হওয়ায় তারা নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে রয়েছে। তারা দুজনই বর্তমানে সুস্থ আছে।
জানা গেছে, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার কে টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় খোলার পর দুই দিন ক্লাসে উপস্থিত ছিল। গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে অনুপস্থিত থাকায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই শিক্ষার্থীর খোঁজ নেয়। পরে করোনার লক্ষণ থাকায় তার নমুনা টেস্ট করানো হয়। ২১ সেপ্টেম্বর টেস্টে তার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়। তার পরিবারের সদস্যরা কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি।
অন্যদিকে কোটালীপাড়া উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী প্রথম দিন বিদ্যালয়ে গেলে তার করোনার লক্ষণ ধরা পড়ে। শিক্ষকরা তাকে ওই দিনই বাড়িতে পাঠান এবং নিজ বাসায় কোয়ারেন্টিনে থাকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষার্থীর করোনা টেস্ট করোনা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর তার পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ওই শিক্ষার্থীও বর্তমানে সুস্থ আছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম জানান, আক্রান্ত দুই শিক্ষার্থী সুস্থ আছে। স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম (এসওপি) অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। করোনার লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর তারা নিজ নিজ বাসায় কোয়ারেন্টিনে রয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে ২২ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুবর্ণা ইসলাম রোদেলা নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সুবর্ণা এস কে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। গত ৩ দিন ধরে সে জ্বর এবং শ্বাসকষ্টে ভুগছিল। ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।