রোদ উঠলেও কমেনি শীতের তীব্রতা : বৃষ্টির আভাস
চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে দুস্থ শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ অব্যাহত
স্টাফ রিপোর্টার: রোদের দেখা মেলায় অবশেষে দিনের তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। এতে দিন ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান বেড়ে শীতের তীব্রতা কোথাও কোথাও কিছুটা কমেছে। ঘন কুয়াশা কেটে রোদের উষ্ণতায় আজ সোমবার শীত পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। একই সঙ্গে সপ্তাহের শেষে হালকা বৃষ্টির পূর্বাভাসও দিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল রোববার সকালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমেছিলো ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় এ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। এটাই চলতি শীত মরসুমে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এদিন সকালে ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা আগের দিন শনিবার ছিলো ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাস তুলে ধরে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। চুয়াডাঙ্গা, যশোর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া জেলাসহ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা কিছু এলাকা হতে প্রশমিত হতে পারে বলেও জানান তিনি। এ সময়ে সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে জানিয়ে ওমর ফারুক বলেন, আগামী দু-দিনের মধ্যে রাতের তাপমাত্রা কমতে পারে। আগামী তিনদিন পর হালকা বৃষ্টি বা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে, চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে দুস্থ শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থান করছে। মরসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, যার বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
চুয়াডাঙ্গায় টানা তিন দিন মৃদু শৈত্যপ্রবাহের পর গতকাল রোববার মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর রোববার সকাল ৯টায় চুয়াডাঙ্গায় সারা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কর্মকর্তারা বলছেন, জেলায় গত দুই বছরের মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এর আগে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি ওই মরসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রোববার চুয়াডাঙ্গার পাশাপাশি সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে পার্শ্ববর্তী জেলা যশোরেও। এদিকে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ঘন কুয়াশা ও মেঘলা আকাশের কারণে দিনের বেশির ভাগ সময় সূর্য দেখা না গেলেও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার দিনে সকাল থেকেই চুয়াডাঙ্গায় ঝলমলে রোদের দেখা মিলেছে। কিন্তু বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যাওয়ায় উত্তরের হিমেল হাওয়ায় কনকনে ঠান্ডায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। এতে কৃষিকাজে নিযুক্ত শ্রমিকসহ কর্মজীবী মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।
জেলার হাটকালুগঞ্জে অবস্থিত আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুল হাসান বলেন, জানুয়ারি মাস হিসেবে এ তাপমাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক। রোববার মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। আরও কয়েক দিন এ ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, উত্তর থেকে হিমালয়ের বরফ গলা হিমেল বাতাস ধেয়ে আসায় রোদ ওঠার পরও বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে। কারণ, ঘন কুয়াশা ও মেঘলা আকাশ থাকলে যে পরিমাণ হাওয়া বয়ে থাকে, কুয়াশা ও মেঘ কেটে গেলে পরিমাণ তুলনামূলক বেড়ে যায়।
গতকাল রোববার সকাল আটটার দিকে পৌর এলাকার হাজরাহাটি গ্রামের মাঠে দেখা যায়, তীব্র শীতের মধ্যেও কাদাপানিতে দাঁড়িয়ে বীজতলা থেকে বোরো ধানের চারা সংগ্রহ করে আবাদি জমিতে রোপণ করছেন কৃষিশ্রমিকেরা। শ্রমিক দলের প্রধান আছির উদ্দিন জানান, সকাল ছয়টার দিকে তারা সদর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়নের সরিষাডাঙ্গা গ্রাম থেকে বাইসাইকেলে হাজরাহাটি গ্রামে কাজে এসেছেন। সেখানে কর্মরত শ্রমিক মাহবুল হোসেন বলেন, ‘অ্যারাম জাড় ইর আগে লাগিনি। মনডা এট্টুও চাচ্চিল না যে কাজে আসি, প্যাটতো আর মানে না। কাজ না করলি খাতি দেবে কিডা। বউ, ছেলে-মেয়েদের কষ্টের কতা ভাইবে টালা জাড়ের মদ্যিই কাজে আইচি।’ একই কথা বলেন কৃষি শ্রমিক শের আলী, হাসিবুল ও ইন্নান হোসেন। ইন্নান বলেন, ‘মুরব্বিগের কাচে শুনিচি কষ্ট করলি কেষ্ট মেলে। তাই, খাইয়ে পরে বাঁইচে থাকতি টালা শীতির মদ্যিই কষ্ট কইরে কাজে আইচি। জানি না, কদ্দিন অ্যারাম কটিন ঠান্টা থাকবে।’
এদিকে, চুয়াডাঙ্গায় মিনিস্টার গ্রুপের আয়োজনে হতদরিদ্র, শীতার্ত মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল রোববার বিকেল সাড়ে তিনটায় চুয়াডাঙ্গা কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজে ২০০০ শীতার্ত নারী পুরুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুর রহমান, চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্মসাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন, চুয়াডাঙ্গা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আলাউদ্দিন হেলা, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের প্রমুখ। মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ রাজ্জাক খান এ সময় উপস্থিত সকল শীতার্ত নারী পুরুষের কাছে গিয়ে তাদের মাথায় হাত রেখে এবং কুশল বিনিময় করে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।
অপরদিকে, চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ইয়াকুব হোসেন মালিক। রোববার বেলা ৩টায় চেম্বার ভবন মিলনায়তনে ছিনুমূল ও নিম্ন আয়ের অসহায় শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম ভূইয়া। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব সভাপতি সরদার আল আমিন। শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহারিন হক মালিক, সহ-সভাপতি মঞ্জুরুল আলম মালিক লার্জ, পরিচালক সালাউদ্দিন মো. মর্তুজা, এস.এম.তসলিম আরিফ বাবু, একেএম সালাউদ্দিন মিঠু, আরিফ হোসেন জোয়ার্দ্দার সোনা, মো. হারুন অর রশিদ, কিশোর কুমার কু-ু, নাসির আহাদ জোয়ার্দ্দার প্রমুখ। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন চুয়াডাঙ্গা চেম্বারের পরিচালক হারুন অর রশিদ।
অন্যদিকে, শীতার্ত মানুষের কথা চিন্তা করে তাদের মাঝে শীতবস্ত্র হিসেবে কম্বল বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ভিত্তিক গ্রুপ চুয়াডাঙ্গা পরিবার। গত কয়েকদিনে গ্রুপটির পরিচালকবৃন্দ জেলার ৪টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে শতাধিক কম্বল বিতরণ করেছেন। প্রচ- শীতের মধ্যে আলমডাঙ্গা উপজেলার পরিচালক তাসলিমা খাতুন, সদরের জহিরুল ইসলাম জনি, আশরাফুল প্রধান, জীবননগরের সাংবাদিক নয়ন আহম্মেদ, সম্রাট হোসেন ও এ আর ডাবলু এবং দামড়হুদাতে তালহা শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করছেন।
কার্পাসডাঙ্গা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গায় অসহায় ও দুস্থ শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল রোববার বিকেল ৪টার সময় কার্পাসডাঙ্গা এমএম ইটভাটা প্রাঙ্গণে কার্পাসডাঙ্গা ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জাব্বার খাবলীর নিজ উদ্যোগে অসহায় ও দুস্থদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কার্পাসডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আতিয়ার রহমান, ইউপি হিসাবরক্ষক ও কম্পিউটার অপারেটর মো. হাসিব, মো. মেসবাহুর রহমান, শাহেদ আলী, ইকরামুল, সম্রাট, জাহিদ প্রমুখ। উল্লেখ্য যুবলীগ নেতা জাব্বার খাবলী নিজ উদ্যোগে প্রতি বছর এলাকার অসহায় ও দুস্থ শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করেন।
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, হাঁড় কাঁপানো শীতে জবুথবু হয়ে পড়েছে জীবননগরবাসী। হিমেল হাওয়া ও তীব্র ঠা-ায় মানুষ ও পশু-পাখির জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ৩ দিন পর গতকাল রোববার সুর্যের মুখ দেখা গেলেও হিমেল হাওয়ার কারণে শীতের তীব্রতা খুব একটা কমেনি। শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে খড় কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তীব্র শীতের কারণে দিনমজুররা কৃষি ক্ষেতে কাজে যেতে না পেরে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শীতের কারণে বৃদ্ধ ও শিশুসহ পশু-পাখির কোল্ড ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ^াসনালীর প্রদাহ ও সর্দি-জ¦রসহ শীতজনিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে।