মহাসিন আলী: মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১১৬ নং মেইল পিলার সংলগ্ন নবীননগর (খালপাড়া) গ্রাম। ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পর গ্রামের ২৪০ ঘর বাসিন্দাদের মধ্যে ২০০ ঘর ভারতে এবং মাত্র ৪০ ঘর বাসিন্দা তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্থান অংশে পড়ে। তখন থেকেই ৭৩ বছর পার হলেও ওই ৪০ ঘর বাসিন্দা নিয়ে নবীননগর খালপাড়া যেন স্বাধীন বাংলাদেশের আরো একটি ছিটমহল। নানা সমস্যার মধ্যেও তাদের ওই স্থান থেকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। তাই তারা যেন নিজ দেশে পরবাসী। মেহেরপুর সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসের হিসেব মতে বুড়িপোতা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের খালপাড়া অংশের মোট ভোটার সংখ্যা ৮৪ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৩৮ জন ও মহিলা ভোটার ৪৬ জন।
স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ বাসিন্দা নজরুল ইসলাম (৮৫) জানান, ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের অনেক বছর আগে জমিদার নবীন বাবু ওই স্থানে তার অনুগত প্রজাদের বসিয়ে জমিদারী পরিচালনা করতেন। তারই নাম অনুসারে গ্রামটি নাম হয় নবীননগর। ওই গ্রামে তার প্রজা ছিলো ২৪০ ঘর। দেশ বিভাগের সময় গ্রামের মোট ২৪০ ঘর বসতির মধ্যে ২০০ ঘর মানুষ ভারতে আর মাত্র ৪০ ঘর মানুষ পূর্ব পাকিস্থান অংশে পড়ে। সেই সময় থেকেই পাকিস্তান অংশের নাগরিকরা সুবিধা বঞ্চিত। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর কয়েক ঘর মানুষ আস্তে আস্তে ওই স্থান থেকে সরে মেহেরপুর শহর, বুড়িপোতা কিংবা বাড়িবাঁকা গ্রামে জায়গা কিনে বাড়ি করেছেন। নানা প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও একই স্থানে বাংলাদেশের বাসিন্দা হয়ে বর্তমান বসবাস করছেন প্রায় ৩৫ ঘর মানুষ। বিভিন্ন সময়ে বুড়িপোতা ইউনিয়নের একাধিক চেয়ারম্যান ভারতের কাঁটাতারের সীমান্ত থেকে তাদের সরিয়ে নিয়ে বুড়িপোতা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বিভিন্ন প্রকার সুযোগ সুবিধার অফার দিয়ে বসবাস করার আহ্বান জানালেও তা প্রত্যাখান করে ওই স্থানে রয়ে গেছেন নবীননগর খালপাড়ার মানুষগুলো। তিনি আরো বলেন- কাঁটাতারের বেড়ার ওপারের নবীননগর গ্রামের বাসিন্দারা ভারতের নদীয়া জেলার তেহট্ট থানার নাটনা কোম্পানির নবীননগর সাব-কোম্পানি ক্যাম্পের বিএসএফ’র এবং নবীননগর খালপাড়াবাসী বাংলাদেশের মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা কোম্পানি ক্যাম্প বিজিবি’র নজরদারীতে থাকেন। মাঝে-মধ্যে ভারত-বাংলাদেশের পুরাতন নবীননগরে বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠক করেন।
নবীবনগর (খালপাড়া) গ্রামের বাসিন্দা হিসাব আলী (৬৭) জানান, মেহেরপুর জেলা শহর থেকে এ গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৮ কিঃ মিঃ। মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা ইউনিয়নের যে কোন নিকটতম গ্রাম থেকে কমপক্ষে ৩ কিঃ মিঃ দূরে ভারত সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়ার বাংলাদেশ পারে নবীননগর (খালপাড়া) গ্রামের অবস্থান। দেশ বিভাগের পরও নবীননগর গ্রামের খালপাড়ার অংশ পুর্ব পাকিস্থান তথা বাংলাদেশে আর নবীননগর গ্রামের সিংহভাগ অংশ ভারতে পড়ে। তবে সে সময় কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় ভারতের নবীননগর অংশ ও পাকিস্থানের নবীননগর (খালপাড়া) অংশের বাসিন্দারা সুখে-দুঃখে পাশাপাশি থেকে বসবাস করেতেন। দেশ বিভাগের ৫০ বছর পরে ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকার নবীননগর গ্রামের ভারতের অংশের ২০০ ঘর মানুষকে সরিয়ে নেয় ভারতের আরো ভেতরে। ২০০৩ সালে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের সময় নবীননগর গ্রামের ভারতের ওই অংশ কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে চলে যায়। বাকি ৪০ ঘর লোক নবীননগর খালপাড়াতে বাস করছে। ভারত সরকার তাদের অংশের মানুষগুলো এমনভাবে সরিয়ে নিয়েছে যে একই মায়ের গর্ভের ২ ছেলে হিসাব ও শহিদুল বাংলাদেশের নবীননগর খালপাড়াতে এবং কিতাব, সিতাব, আকবর, হাসিদুল ও ছাব্দার বসবাস করছেন ভারতের কাঁটাতারের ওপারের নবীননগরে। একই কারণে আব্দুল হান্নান, আমানুল ও মিয়ারুল ৩ ভাই বর্তমানে বাংলাদেশের এবং জামানুল ও সদর ওরফে পাখি নামের ২ ভাই ভারতের বাসিন্দা। এছাড়া এমন আরো ২ টি পরিবার আছে যাদের আপন ভাইদের কেউ বাংলাদেশ অংশে আবার কেউ ভারতের অংশে বাস করছেন।
বয়োবৃদ্ধ ময়না খাতুন জানান, নবীননগর খালপাড়ার মানুষ চাষাবাদ আর গরু-ছাগল পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। সম্প্রতি কয়েক বছরে গ্রামের কয়েকজন যুবক কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছেন। এ স্থানের মানুষগুলো পরস্পর সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মধ্যে বাসবাস করেন। বিএসএফ’র কাছে নিজেদের পরিচয়পত্র জমা দিয়ে কাঁটাতারের এপারের জমি চাষাবাদ করতে আসা ভারতীয় মানুষগুলো আজও খালপাড়াবাসীর খোঁজখবর নিয়ে আবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে কাঁটাতারের বেড়ার ওপার ভারতে ফিরে যান।
প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম জানালেন, নানা প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে খালপাড়ার প্রায় ৩৫ ঘর মানুষ বাপ-দাদার ভিটে আকড়ে ধরে বসবাস করছেন। বর্তমানে গ্রামের লোাক সংখ্যা প্রায় পৌনে দুইশ’। গ্রামটিতে নেই কোন স্বাস্থ্য ক্লিনিক। খালপাড়া থেকে মেহেরপুর শহরে যেতে কমপক্ষে ৩ কিঃমিঃ কাঁচারাস্তা পাড়ি দিয়ে বাড়িবাঁকা পর্যন্ত পৌঁছে পাকারাস্তায় উঠতে হয়। এরপর শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নছিমন, করিমন কিংবা আলগামনে করে মেহেরপুর পৌঁছাতে হয়। তবে ওই গ্রামবাসীর ফিরে আসার অপেক্ষায় কোন নছিমন, করিমন কিংবা আলগামন অপেক্ষায় থাকেনা। বড় সমস্যা প্রতিবছর বর্ষায় রাতে কিংবা দিনে কোন মানুষ অসুস্থ হলে তাকে খাটুলি করে খালপাড়া গ্রাম থেকে মেহেরপুর নিতে হয়। তিনি আরো জানান, গ্রামটিতে নেই কোন খেলার মাঠ। কাঁটাতারের বাংলাদেশ পারে খালপাড়া গ্রামের শিশু-কিশোর ও তরুণরা ভারতের অংশে অবস্থিত খোলা জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খেলাধূলা করতো। বিএসএফ’র পক্ষ থেকে কড়াকড়ি হওয়ায় তাদের খেলাধূলা বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামের শত বছরের পুরাতন মসজিদটি কাঁটাতারের এপারের ভারতের অংশে অবস্থিত। গ্রামের ২ জন বৃদ্ধ এখনও মসজিদটিকে নিয়মিত আজান দেন, নামাজ পড়েন ও সন্ধ্যাবাতি জ্বালান। বর্তমানে বাংলাদেশের খালপাড়া অংশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, ১৯৯২ সালে স্থাপিত নবীনগর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বর্তমানে নবীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের কেউ প্রাথমিক সমাপনি শেষ করলেও মাধ্যমিকের জন্য কমপক্ষে ৩ কিঃমিঃ কাঁচারাস্তা পাড়ি দিয়ে নিকটবর্তী শালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে হয়। যা মেয়েদের জন্য এক প্রকার দূঃসাধ্য কাজ।
বুড়িপোতা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ মুকুল জানান, নানা প্রতিকুল অবস্থার কারণে আমি বহুবার চেষ্টা করেছি নবীননগর খালপাড়ার মানুষগুলোকে বুড়িপোতা ইউনিয়নের বাড়িবাঁকাসহ অন্যকোন গ্রামে সরিয়ে নিতে। কিন্তু তাদের থেকে কোন সাড়া পাইনি। তবে আমার সময় গ্রামের কয়েকশত ফুট রাস্তা হ্যারিং করে দিয়েছি।
বুড়িপোতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ জামাল জানান, নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ওই গ্রামের লোকগুলোর সুখ-দুঃখের কথা ভেবে তাদের সরিয়ে নিতে চেয়েছি কিন্তু তারা ওই স্থান থেকে সরে আসতে চান না। ইতোমধ্যে বাড়িবাঁকা গ্রামের শেষ পিচরাস্তা থেকে দেড় কিলোমিটার হ্যারিং রাস্তা করে দিয়েছি। আবারো টেন্ডার হয়েছে ওই দেড় কিলো মিটার রাস্তা পিচ করার। সত্বর কাজ শুরু হবে। এছাড়া তাদের বড় সমস্যা পিচ রাস্তার সুবিধা দিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এমপি’র সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি আগামী অর্থ বছরে বাকি টুকু পিচ করে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ^াস দেন।
মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৪ সালের ৩০ মে আমি ওই গ্রামে বিদ্যুৎ উদ্বোধন করেছি। এ মুহুর্তে বিনোদন ও খবর শোনার জন্য ডিস লাইন সংযোগ দিয়েছেন বে-সরকারি সংস্থা ডিস কেবল অপারেটর এনএসএফ। ১৯৯৯ সালে ওই গ্রামের ৪৫০ ফুট ও ২০১৪ সালে ১২০ ফুট রাস্তা হ্যারিং করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তাদের চলাচলের সুবিধার্থে ওই ৩ কিঃ মিঃ রাস্তা পাকা করণসহ গ্রামের অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে।