স্টাফ রিপোর্টার: তীব্র শীতে কাঁপছে চুয়াডাঙ্গা। কমছে পারদের তাপমাত্রা। ঘন কুয়াশা বাড়িয়ে দিচ্ছে শীতের মাত্রা। হুল ফুটানো শীতল বাতাস আর কনকনে ঠান্ডায় স্থবির হয়ে পড়ছে জনজীবন। চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। গত রোববার দিবাগত মধ্যরাত থেকে জেলার ওপর দিয়ে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সকালে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারন করেছেন খেটে খাওয়া ছিন্নমূল মানুষ। সকাল ৯টার পর সূর্যের দেখা মিললেও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহে শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। শীতে ব্যাহত হচ্ছে কৃষিকাজ। তীব্র ঠান্ডায় দেখা দিচ্ছে শীতজনিত নানা রোগ। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। গত তিনদিনে ডাইরিয়ায় আক্রান্ত ৮৩, শিশু ওয়ার্ডে ৫৬ রোগী ভর্তি হয়েছে। এখনও পর্যন্ত হাসপাতালে রোগীর চাপ স্বাভাবিকের মধ্যে থাকলেও কুয়াশা ও ঠান্ডা বাড়ার সঙ্গে ঠান্ডা জনিত রোগীর সংখ্যাও বাড়বে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। অপরদিকে, শীত নিবারণের জন্য নিম্নআয়ের মানুষগুলো ভীড় করছেন শহরের ফুটপাতের পুরনো শীতবস্ত্রের দোকানগুলোতে। পড়েছে শীতের কেনাকাটার ধুম। যে যার সাধ্যমতো শীতবস্ত্র কেনাকাটা করছেন। চুয়াডাঙ্গার নিউ মার্কেট, পুরাতন গলি, আব্দুল¬া সিটি, প্রিন্সপ¬াজা, রেলবাজারসহ বিভিন্ন বিপণি দোকানগুলোতে ক্রেতাদের শীতবস্ত্র কিনতে দেখা যায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সোমবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আবার শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার পূর্বাভাসও দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। শীতের কারণে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন শীতজনিত রোগ বালাই। হাসপাতালে নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা না বাড়লেও ডায়েরিয়াসহ বাড়ছে বিভিন্ন রোগীর সংখ্যা। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত তিনদিনে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে ৮৩ রোগী। অপরদিকে গত তিনদিনে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে ৫৬ জন শিশু। এর মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ১০জন রয়েছে। এছাড়া বহির্বিভাগেও প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছে শতাধিক রোগী। গতকালই ডাইরিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন ১৮ জন এবং শিশু ওয়ার্ডে ১২ জন ভর্তি হয়েছে। গতকাল সদর হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, পুরো হাসপাতালজুড়ে শুনশান নীরবতা। তীব্র শীতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ আসছেন না। প্রতিটি ওয়ার্ডে বেশির ভাগ রোগীদের সাথে স্বজনদের দেখা মেলেনি। কথা হয় ডাইরিয়া ওয়ার্ডের ইমন নামে এক শিশুর মায়ের সাথে। কয়েকদিন থেকেই তার ছেলের সর্দি-কাশি ও হালকা জ্বর আছে। স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো উন্নতি না হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন ছেলেকে। শিশু ওয়ার্ডে এক রোগীর স্বজন বলেন, আমার মেয়ের বয়স আজ ৩ মাস। গত তিনদিন ধরে ঠান্ডা আর কাশি হচ্ছে। গতকাল দুপুরে ভর্তি করেছি। প্রচন্ড শীত আর ছোট বাচ্চা নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
অপরদিকে, তীব্র শীতে প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। ফলে সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়েছেন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো। এলাকার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ও চায়ের দোকানে শীত নিবারণের চেষ্টায় আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নিতে দেখা গেছে নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে।
রিকশাচালক আসলাম উদ্দিন বলেন, আজ প্রচন্ড শীত লাগছে। ঠান্ডার জন্য রিকশা চালানো যাচ্ছে না। হাত ও পায়ের পাতা মনে হচ্ছে বরফ হয়ে যাচ্ছে। পেটের দায়ে বাড়ি থেকে বের হলেও প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাচ্ছে না। হালকা বাতাসে পুরো শরীর কাঁপছে। এ রকম আরও কয়েকদিন হলে সকালে কাজে বের হওয়া যাবে না।
বেসরকারি চাকরিজীবী আশরাফুল হক বলেন, সকাল ৮টার মধ্যে অফিসের উদ্দেশে বের হতে হয়। প্রচ- শীতের কারণে রিকশা না নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। যেন শরীরটা একটু গরম থাকে। কিন্তু হিমেল হাওয়ায় জবুথবু অবস্থা।
আবুল কালাম আজাদ নামে একজন হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, সকালে নাস্তার জন্য হোটেলে চাপ থাকে। এজন্য ফজরের আজানের পর থেকেই কাজের চাপ। পানিতে হাত পড়লে মনে হচ্ছে অবশ হয়ে যাচ্ছে। আঙুলগুলো নাড়ানো যাচ্ছে না। তারপরও কাজ করছি।
এদিকে শৈত্যপ্রবাহের কারণে চুয়াডাঙ্গা শহরে সাধারণ মানুষের চলাচল অনেকাংশে কমে গেছে। তবে শহরের নতুন ও পুরোনো শীতবস্ত্রের দোকানগুলোতে বেশ ভিড় দেখা গেছে।শীতের পোশাক কিনতে আসা রমজান আলী বলেন, হঠাৎ শীত বেড়ে যাওয়ায় শীতের পোশাকের দাম একলাফে বেড়ে গিয়েছে। দোকানিরা ইচ্ছেমতো দাম হাঁকাচ্ছেন। ফলে শীতের নতুন পোশাক কেনা সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সামাদুল হক দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানান, সোমবার সকাল ৯ টায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটাই জেলায় এ মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। আজ থেকে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। থাকবে ২/৩ দিন। এ তাপমাত্রা আরও কমতে পারে বলেও জানান তিনি।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) এএসএম ফাতেহ আকরাম বলেন, খাবারের কারণে ডাইরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে শিশু রোগীর সংখ্যা ও বাড়ছে। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে রোগীর চাপ কম রয়েছে। প্রতিদিন ৭০-৮০ শিশু ও বয়স্ক রোগী ঠান্ডাজনিত কারণে আউটডোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে কুয়াশা ও ঠান্ডা বাড়ার সঙ্গে রোগীর সংখ্যাও বাড়বে।
পরামর্শ দিয়ে বলেন, শিশুদের ঠিকমতো টিকা প্রদান ও ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো হলে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। তাছাড়া ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে শিশুকে দূরে রাখা এবং গরম কাপড় পরিধান করানো অত্যন্ত জরুরি। ডায়রিয়া এক ধরনের পানিবাহিত রোগ। রোটা ভাইরাসের কারণেও ডায়রিয়া হয়ে থাকে। ৬-১৬ মাস বয়সী আক্রান্ত শিশুকে ঘনঘন স্যালাইন ও মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়া শিশুদের মায়ের বুকের দুধ ও রোটারিং টিকা দিলে ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। তিনি আরও বলেন, এসব রোগ থেকে রক্ষা পেতে শিশুদের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত নিয়মিত বুকের দুধ পান করাতে হবে। সব শিশুর প্রতি যতœশীল হতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। শিশুদের জ্বর, অস্বাভাবিক কাশি ও পাতলা পায়খানা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। মুখে খাবার স্যালাইন দেয়া যেতে পারে। শিশু যদি বুকের দুধ পান করে তা চালিয়ে যেতে পারে। চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতিত বাচ্চাকে ডায়রিয়ার জন্য “এন্টি-ডায়রিয়াল” কোন ওষুধ দেয়া যাবে না। কারণ এর ফলে সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া বাচ্চার যদি প্রচুর সংক্রমন থাকে ও পানিশূন্যতা থাকে, বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করা লাগতে পারে। হাসপাতালে চিকিৎসক বাচ্চাকে শিরার মাধ্যমে ফ্লুইড দিতে পারেন পানিশুন্যতা দূর করতে। আপনার হাত ভালভাবে সাবান দিয়ে পরিস্কার করুন বাচ্চার ডায়পার পরিবর্তনের পর। খাবার রান্না করার পাশে বাচ্চার ডায়পার পরিবর্তন করবেন না। বাচ্চার ডায়পার ভালভাবে পলিথিন ব্যাগে প্যাক করে ফেলবেন। ডায়পার পরিবর্তনকৃত স্থানে ভাল ভাবে পরিস্কার করতে হবে। ডায়াপার, খেলনা, যেসব জায়গায় ডায়াপার বদল করা হয় (বাসায় বা ডেকেয়ার সেন্টারে), হাত পরিষ্কার করার স্থানে, এমনকি খাবার তৈরি করার স্থানেও এই ভাইরাস থাকতে পারে। এটি অনেক দিন বেঁচে থাকে। এ কারণে এমন সব স্থান ও খেলনা প্রতিদিন অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার জানান, সরকারিভাবে জেলায় প্রায় ২১ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। ব্র্যাক থেকে ৩৫০টি কম্বল উপহার পাওয়া গেছে এবং আরও ৯৫০টি কম্বল কেনা হয়েছে। এছাড়া শীতবস্ত্র কেনার জন্য ৪ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা করে ২৮ লাখ টাকা ও ৪ পৌর মেয়রের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা করে ৮ লাখ টাকা সরকারি বরাদ্দ মিলেছে। শিগগিরই এই অর্থ শীতার্ত মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
এদিকে, শৈত্যপ্রবাহ আর হাঁড় কাঁপানো শীতে মানুষসহ প্রাণীকূল হয়ে পড়েছে জবুথবু। শীত নিবারণের জন্য নিম্নআয়ের মানুষগুলো ভীড় করছেন শহরের ফুটপাতের পুরনো শীতবস্ত্রের দোকানগুলোতে, পড়েছে শীতের কেনাকাটার ধুম। যে যার সাধ্যমত শীতবস্ত্র কেনাকাটা করছেন। চুয়াডাঙ্গার নিউ মার্কেট, পুরাতন গলি, আব্দুল¬া সিটি, প্রিন্সপ¬াজা, রেলবাজারসহ বিভিন্ন বিপণি দোকানগুলোতে ক্রেতাদের শীতবস্ত্র কিনতে দেখা যায়। পুরাতন কাপড়ের দোকানগুলোতে ভালো মানের পোশাকও পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে মধ্যবিত্তদের আনাগোনা বেশি দেখা যাচ্ছে। শীতের এ সময় চুয়াডাঙ্গা পোস্ট অফিসের সামনে, পুরাতন জেলখানার পাশে, রেলবাজারসহ বেশ কয়েকটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে পুরনো শীতবস্ত্র। এসব দোকানে জ্যাকেট, সোয়েটার, কোট, মাফলার, গেঞ্জি, মোজা ও মেয়েদের বিভিন্ন ডিজাইনের গরম কাপড়ের পসরা সাঁজানো রয়েছে। তাছাড়া কিছু ব্যবসায়ী ভ্যানে করে বিভিন্ন হাট-বাজারে পাড়া-মহল্ল¬াতে ঘুরে ঘুরে ৩০ টাকা দরে বাচ্চাদের বিভিন্ন রকম গরম কাপড় বিক্রি করছেন। ক্রেতা শরিফুল ইসলাম, আজিজুল হক, ও সেফালি খাতুন বলেন, শীতের পোশাক কিনতে এসেছি মার্কেটগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম প্রত্যেকটি শীতের পোশাকের দাম অনেক বেশি। তাই পুরাতন কাপড়েড় দোকানে আসলাম তবে এখানেও দেখছি আকাশ ছোঁয়াদাম বলছে বিক্রেতা। পুরাতন কাপড় ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন, আরিফুল ইসলাম, আবুল হোসেন জানান শীত বেড়ে যাওয়ায় বেচাকেনা ভাালো হচ্ছে। ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ৫শ, থেকে হাজার টাকা দরেরও পোশাক রয়েছে। তাছারা ধনী ক্রেতাদের পোশাক পছন্দ হলে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকায়ও বিক্রি করা যায়। গরম কাপড় কিনতে আসা কয়েকজন জানান, আমরা গরিব মানুষ। আমাদের কী আর বড় বড় মার্কেট থেকে কাপড় কেনার সামর্থ্য আছে। তাই এখানে এসেছি। এখানে বিভিন্ন দোকান ঘুরে মেয়ের জন্য ২শ’ টাকা ও ছেলের জন্য আড়াইশ টাকা দিয়ে একটা সোয়েটার নিয়েছি।
চুয়াডাঙ্গা চৌরাস্তা মোড়ের ভ্রাম্যমাণ একজন ব্যবসায়ী জানান, কয়েকদিন ধরেই চুয়াডাঙ্গায় শীত বেড়েছে। এ জন্য শহরের ভ্রাম্যমাণ শীতবস্ত্রের দোকানে কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। ক্রেতাদের চাহিদার কথা ভেবে ছোট-বড়দের জ্যাকেট, মাফলার, সোয়েটার, হাত মোজা, কোট, টুপি সবই মিলছে এসব দোকানে। দাম সস্তা হওয়ায় নিম্নবিত্ত ক্রেতাদের কাছে এই কাপড়ের চাহিদা বেশি।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ