থানায় নিয়ে আর্থিক সাহায্যসহ অভিযুক্তকে বাড়ি ফিরিয়ে দিলেন চুয়াডাঙ্গার ওসি
স্টাফ রিপোর্টার: রাস্তার ধারে বসে সারাদিনের কষ্টার্জিত টাকা গুনছিলেন বৃদ্ধা ভিক্ষুক নিছারন বিবি। এমন সময় একজন ছোঁ মেরে তার হাতের টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। সারাদিন ঘুরে ঘুরে অর্জিত ভিক্ষাবৃত্তির টাকা হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় শুরু হওয়া তোলপাড় চলে যায় পুলিশের মাঝেও। ঘটনাটি গত ২৬ জুলাই সোমবার চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ বাজারের একটি তেলপাম্পের সামনে ঘটে।
অভিযুক্তকে ধরতে শুরু হয় পুলিশের অনুসন্ধান। সিসিক্যামেরার ফুটেজসহ সংগ্রহ করা হয় নানা তথ্য-উপাত্ত। অবশেষে গতকাল শুক্রবার মেলে সন্ধান। অভিযুক্তকে নেয়া হয় থানায়। তবে, তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে পৌঁছে দেয়া হয়েছে বাড়িতে। করা হয়েছে আর্থিক সহযোগিতাও।
হ্যাঁ, বৃদ্ধার টাকা ছিনিয়ে নেয়া ওই অভিযুক্তের কথায় বলা হচ্ছে। সামান্য মাছ-ভাত খাওয়ার জন্যই ভিক্ষুকের টাকা ছিনিয়ে নেয় দীর্ঘদিন ভালো খাবার না পাওয়া ৮ বছর বয়সী ওই শিশু। দারিদ্র্য পরিবারের সন্তান। গোশভাত তো দূরের কথা মাছ-ভাতও জোটেনি দীর্ঘদিন। খেতে পারে না ভালো খাবার। গত সোমবার মায়ের কাছে মাছভাত খাওয়ার আবদার করে ওই শিশু। কুড়িয়ে কাড়িয়ে পাওয়া ৬০ টাকা ছেলের হাতে তুলে দেয় মা। মায়ের দেয়া ষাট টাকা নিয়ে বাজারে যায় মাছ কিনতে ছোট্ট ছেলেটি। পথের মধ্যে টাকাগুলো হারিয়ে ফেলে সে। এ সময় দিশেহারা হয়ে পড়ে শিশুটি। কয়েক ঘণ্টা সে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করতে থাকে। ঠিক ওই সময় রাস্তার পাশে সারাদিনের অর্জিত টাকাগুলো গুনছিলেন বৃদ্ধা ভিক্ষুক নিছারন বিবি। বিষয়টি দেখে শিশুটি ওই ভিক্ষুকের কাছাকাছি যায়। একপর্যায়ে ভিক্ষুকের হাত থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় সে। ওই টাকা দিয়ে ছোট্ট একটা মাছ কিনে বাড়ি ফেরে।
এদিকে, ভিক্ষা করে সংগ্রহ করা সব টাকা হারিয়ে কাঁদতে থাকেন অসহায় ভিক্ষুক নিছারন বেগম। বিষয়টি নিয়ে ওই এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। অসহায় বৃদ্ধার টাকা ছিনিয়ে নেয়ার পর তার কান্নায় গলতে দেখা গেছে অনেক পাথরের মনও।
বিষয়টি জানার পর নড়েচড়ে বসেন সদর থানা ওসি আবু জিহাদ ফখরুল আলম খান। অভিযুক্ত ছিনতাইকারীকে ধরতে ওসির নেতৃত্বে অনুসন্ধান শুরু করেন এসআই হাসানুজ্জামান। জোগাড় করতে থাকেন ভিডিও ফুটেজ। টানা তিনদিনের পুলিশের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের পর শুক্রবার শনাক্ত করা হয় অভিযুক্তকে। চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করা এ ঘটনায় পুলিশের ঘোড় কাটে ওই শিশুকে থানায় নেয়ার পর। পরে পুলিশের কাছে উপরোক্ত বিষয়টিগুলো বর্ণনা করেন ছোট্ট শিশু মুন্না। পরে মুন্নার পরিবারের সাথে কথা বলে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা শোনার পর পুলিশ রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। পল্টুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ভিক্ষুক এবং ওই শিশুর হাতে আর্থিক সাহায্য তুলে দেন সদর থানার ওসি আবু জিহাদ খান। পরে মানবিক দিক বিবেচনায় শিশুকে তার মায়ের জিম্মায় পৌঁছে দেয়া হয়।
যেভাবে শিশুটির কাছে পৌঁছে পুলিশ: সিসিটিভির ক্যামেরার ফুটেজ, শিশুটির আপন চাচা সরোজগঞ্জ বাজারের মাছব্যবসায়ীসহ বেশ কয়েকটি সূত্র নিয়ে এগোতে থাকে পুলিশ। পুলিশ জানায়, সদর থানার ওসি আবু জিহাদ খানের নেতৃত্বে এসআই হাসানুজ্জামান অভিযুক্ত যুবককে ধরতে ঘটনাস্থলের লোকজনের সাথে কথা বলেন। সেখানে কোন সূত্র না পেয়ে আশেপাশের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে শিশুটিকে চিহ্নিত করে পুলিশ। এর আগে শিশুটিকে নিয়ে সরোজগঞ্জ এলাকায় বসবাস করেছিলেন তা মা। সেই সূত্র ধরে শিশুটির আপন চাচা মাছ ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় শুক্রবার সকালে ঝিনাইদহ পৌর এলাকার থেকে শিশুটিকে নিয়ে থানা হেফাজতে নেয়া হয়। পরে সেই ভিক্ষুক নিছারন বেগম গিয়ে শনাক্ত করেন।
ওসি আবু জিহাদ বলেন, ঘটনা জানার পরই অভিযুক্তকে ধরতে এসআই হাসানুজ্জামানকে নির্দেশ দেয়া হয়। তিনদিনের প্রচেষ্টায় ঘটনা উদ্ভাবিত হয়। তবে এমন ঘটনার স্বাক্ষী এর আগে হয়নি। তিনি বলেন, শিশুটি দীর্ঘদিন মাছসহ ভাল খাবার খায়নি। তাই মায়ের কাছে বাইনা করে মাছ খাবে বলে। মায়ের কাছে থাকা মাত্র ৬০ টাকা দিয়ে ঝিনাহদহ থেকে সরোজগঞ্জ বাজারে তার মাছ ব্যবসায়ী চাচার কাছে পাঠায়। বাজারে যাওয়ার সময় তার টাকা হারিয়ে গেলে দিশেহারা হয়ে পড়ে বালকটি। সেখানে ওই ভিক্ষুকে টাকা গুনতে দেখে তার টাকা নিয়ে যায় বালকটি। সবদিক বিবেচনা করে ওই ভিক্ষুকসহ পুলিশ তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আপত্তি জানায়। শিশুটি এবং ওই ভিক্ষুককে সদর থানা পুলিশের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে শিশুকে তার মায়ের জিম্মায় দেয়া হয়েছে। ওসি আরও বলেন, ভিক্ষুক নিছারন চোখে কম দেখায় প্রথমে অভিযুক্তকে যুবক বলে জানিয়েছিল। এজন্য আমাদেরও তার কাছে পৌছাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অপরদিকে, সদর থানা পুলিশের এমন কর্মকান্ডকে সত্যিই প্রশংসনীয় বলে দাবিদার করেন সমাজের বিভিন্ন মহল।