পঞ্চম ধাপের ৭০৭ ইউপি নির্বাচন সম্পন্ন : দেশের ৬ জেলায় সংঘর্ষ গুলি অগ্নিসংযোগ
মাথাভাঙ্গা ডেস্ক: ইউপি নির্বাচনের পঞ্চম ধাপের ভোটও রক্তপাতহীন, শান্তিপূর্ণ হলো না। আশঙ্কা করা হচ্ছিলো, অন্যান্য ধাপের মতোই এবারও সহিংসতা ঘটবে। সেই আশঙ্কা সঠিক প্রমাণ করে বুধবার দেশের ৭০৮টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হলো। অনুষ্ঠিত পঞ্চম ধাপের নির্বাচনের ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় দেশে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, ঝিনাইদহ, গাইবান্ধা, চাঁদপুর, নওগাঁ এবং বগুড়ায় নির্বাচনি সহিংসতায় ১২ জনের মৃত্যু হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি হামলা, গোলাগুলি, গাড়ি ভাঙচুরের মতো সহিংসতার ঘটনায় এসব প্রাণহানি ছাড়াও এএসপি, ওসি, সাংবাদিক, চেয়ারম্যান, মেম্বার প্রার্থীসহ আহত হয়েছেন অনেকে। নৌকায় সিল মারতে গিয়ে প্রিসাইডিং অফিসার আটকের ঘটনাও ঘটেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীকে মারধর করে ডোবায় ফেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটিয়েছেন নৌকা প্রার্থীর সমর্থকরা।
গতকাল বুধবার ভোটের দিন বগুড়ায় পাঁচজন, চাঁদপুরে দুজন, গাইবান্ধা, চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, নওগাঁ ও ঝিনাইদহে একজন করে মারা গেছেন। ঝিনাইদহে যিনি মারা গেছেন, তিনি কয়েক দিন আগে সংঘর্ষের এক ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। পঞ্চম ধাপের ভোটে সহিংসতা ছাড়াও জাল ভোট, নৌকা প্রতীকে ভোটদানে বাধ্য করা, কেন্দ্র দখলসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে, সহিংসতায় ১২ জন মারা গেলেও নির্বাচন ভালো হয়েছে বলে দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। নিহতের ঘটনায় দায় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের বলেও দাবি করেন তিনি। সচিব বলেন, বিচ্ছিন্ন কয়েকটি কেন্দ্র ছাড়া উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা যে রিপোর্ট পেয়েছি তাতে এ ধাপে ৭০ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে।
এর আগে চার ধাপে ২ হাজার ৮৪২টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে ভোটের আগে-পরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে সহিংসতায় সারা দেশে এ পর্যন্ত প্রাণহানি হয়েছে ৮৬ জনের। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় ধাপে। ওই ধাপের নির্বাচন ঘিরে ৩০ জন নিহত হন। তবে শুধু ভোটের দিন দ্বিতীয় ধাপে সংঘাতে জড়িয়ে ছয়জন, তৃতীয় ধাপে সাতজন, চতুর্থ ধাপে তিনজন নিহত হন। বেশির ভাগ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও দলের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বালিয়াদীঘি ইউপি নির্বাচনে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে নৌকার প্রার্থী ইউনুছ আলী ফকিরের সমর্থকেরা পুলিশ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও বিজিবির ওপর হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া হয়েছে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে কালাইহাটা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কয়েক দফা গুলি ছুড়েছেন। এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন কালাইহাটা গ্রামের কুলসুম বেগম (৩৫), আবদুর রশিদ (৬০), খোরশেদ আলী (৭০) ও আলমগীর (৪০)।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আলী হায়দার চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গাবতলীর ইউএনও রওনক জাহান বলেন, ওই কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ শেষ হলেও নৌকার প্রার্থীর সমর্থকেরা ভোট গণনায় বাধা দেন। অন্য কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষে তারা ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে বলেন। এতে আপত্তি জানালে নৌকার প্রার্থী ইউনুছ আলী ফকিরের সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রে হামলা চালান। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। নৌকার কর্মী-সমর্থকেরা ইউএনওর গাড়ি ছাড়াও পুলিশ ও বিজিবির মোট চারটি গাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। হামলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বে থাকা শাজাহানপুরের ইউএনও আসিফ আহমেদ ছাড়াও বিজিবি-পুলিশের চার সদস্য আহত হয়েছেন। ইউএনও আরও বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়েছে।
এছাড়া একই উপজেলার রামেশ্বরপুর ইউনিয়নে সদস্য প্রার্থী ফেরদৌস রহমানের সমর্থকদের হামলায় জাকির হোসেন (৩০) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। দুপুরে জাইগুলি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। জাকির একই গ্রামের বাসিন্দা। হামলার আগে তিনি জাইগুলি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে ভোটের চিত্র লাইভ করেছিলেন। ওই প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ সাইদুল ইসলামের সমর্থক অভিযোগে তার ওপর হামলা চালানো হয়।
চাঁদপুরের কচুয়া ও হাইমচরে ছুরিকাঘাতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন কচুয়ার সাচার ইউনিয়নে ও অপরজন হাইমচরের নীলকমল ইউনিয়নে। একটি ঘটনায় বেলা সাড়ে তিনটায় সাচার নয়াকান্দি এলাকায় সদস্য প্রার্থী জাকির হোসেনের সমর্থক শরীফ হোসেনকে (১৮) দুর্বৃত্তরা ছুরিকাঘাত করলে আহত হন তিনি। উদ্ধার করে ঢাকায় হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় ঘটনায় নীলকমল ইউনিয়নের বাহেরচরে বেলা তিনটায় নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী সালাউদ্দিন সরদারের সমর্থক এক যুবককে (২৮) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। তার পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গাইবান্ধার সাঘাটার জুম্মাবাড়ি ইউনিয়নের জুম্মাবাড়ি আদর্শ কলেজ কেন্দ্রের পাশে বিকেলে আবু তাহের (৪০) নামের একজনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এ ইউনিয়নের মামুদপুর গ্রামের ওমর আলীর ছেলে ও সদস্য প্রার্থী আইজল মিয়ার সমর্থক। হত্যাকা-ের আগে আবু তাহেরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রাসেল আহমেদের (পাখা) কর্মী-সমর্থকদের কথা-কাটাকাটি হয়।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের বাচামারা ইউনিয়নে সদস্য প্রার্থী সারোয়ার হোসেন ও ওয়াজেদ সরকারের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে পড়ে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন একজন নারী ভোটার। দুপুরে বাচামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে এ পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। মৃত সুমেলা খাতুন (৫০) চর ডালুটিয়া গ্রামের মো. মাহাতাব আলীর স্ত্রী।
চট্টগ্রামের আনোয়ারার চাতরী ইউনিয়নের একটি ভোটকেন্দ্রের পাশে দুপুরে সদস্য প্রার্থী রঘুনাথ সরকার ও নাজিম উদ্দীনের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষে অংকুর দত্ত (৩০) নামের এক যুবক নিহত হন। সিংহরা গ্রামের নেপাল দত্তের ছেলে তিনি।
নওগাঁর পতœীতলা উপজেলার ইউপি নির্বাচনে ঘোষনগর ইউপির কমলাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্রে করে পুলিশ- স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসময় উত্তেজিত হয়ে স্থানীয়রা পুলিশের ২টি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে নওগাঁর পুলিশ সুপার প্রকৌশলী মো. আব্দুল মান্নান মিয়া বলেন, তিনি ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন এরপর বিস্তারিত জানাতে পারবেন।
ঝিনাইদহের শৈলকুপার সারুটিয়া ইউনিয়নে গত ৩১ ডিসেম্বর নির্বাচন নিয়ে সংঘর্ষের এক ঘটনায় আহত অখিল সরকার (৫৫) নামের এক ব্যক্তি দুপুরে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তিনি সারুটিয়া ইউনিয়নের কিত্তিনগর গ্রামের নিরাপদ সরকারের ছেলে। অখিল এ ইউনিয়নে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহমুদুল হাসানের ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী জুলফিকার কায়সারের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষে আহত হয়েছিলেন।