ব্যাপকভাবে আলোচনায় সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট

সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন করায় বড় চ্যালেঞ্জ

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত কয়েকটি সংস্কার কমিশন সুপারিশসহ রিপোর্ট দিলেও এসব সুপারিশ কতোটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কিংবা আদৌ হবে কি না অথবা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে-তা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। কিছু কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আর কিছু সুপারিশ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারলেও গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে যা কিছুই হচ্ছে সবই আগামী সংসদে অনুমোদন করাতে হবে। ফলে অনেকের মধ্যে এই সংশয়ও আছে সংস্কার বিষয়ক সব সুপারিশ পরবর্তী সংসদ নাও গ্রহণ করতে পারে। রাজনৈতিক দল, বিশ্লেষক ও সংস্কার কমিশনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের কেউ কেউ বলছেন, সুপারিশগুলো সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে কিংবা তাদের মধ্যে যদি ন্যূনতম ঐকমত্য না হয়, তাহলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সুপারিশ শেষ পর্যন্ত ‘কাগজেই’ থেকে যেতে পারে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু স্পষ্ট করে জানিয়েছেন ‘কি সংস্কার হবে বা কতোটা সংস্কার হবে তা ঠিক করবে কেবলমাত্র সংসদ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা’। দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ে সংস্কার কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, রাজনৈতিক দল ও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ওপরই নির্ভর করবে শেষ পর্যন্ত এগুলোর কিছু বাস্তবায়ন হবে কি না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন, সামগ্রিক সংস্কার ইস্যুর ভবিষ্যতটা শেষ পর্যন্ত জনগণের ম্যান্ডেটের ওপর নির্ভর করবে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার জের ধরে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংস্কার ইস্যুটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসলেও শেষ পর্যন্ত দলগুলোর মধ্যকার গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে তা খুব একটা বাস্তবায়ন হয়নি। তখন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (রিপ্রেজেন্টেটিভ পিপলস অর্ডার ১৯৭২) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হলেও নির্বাচনি কার্যক্রমে তার যথাযথ প্রয়োগ কখনোই হয়নি বলে অভিযোগ আছে। আবার ২০২৩ সালে এর যে সংশোধনী আনা হয়েছে তাতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছিলো বলেও অনেকে মনে করে থাকেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে জোরেশোরে উঠে এসেছে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সংস্কারের রূপরেখা নির্ধারণের জন্য সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত মোট ১১টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন, বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশন, ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন এবং সরফরাজ হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে। অন্যদিকে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এবং আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন আগামী ৩১ জানুয়ারি তাদের রিপোর্ট দেয়ার কথা। এছাড়া গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় পেয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট। সেই সাথে সুপারিশ দেয়ার আগেই জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি প্রধানের এক সংবাদ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডারের সাথে চরম বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলো অন্য ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
বিশেষ করে সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে বায়াত্তরের সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ বলেছেন, সুপারিশগুলোর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একনায়কতন্ত্রের পথ বন্ধ করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে।
এই কমিশন সংবিধানে পরিবর্তন এনে বর্তমান এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করা, সরকার ও জাতীয় সংসদের মেয়াদ এক বছর কমিয়ে চার বছর করা, প্রধানমন্ত্রী পদে দুই বারের বেশি না থাকা, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স ২১ বছর করা এবং সংসদের বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার বানানোর প্রস্তাব করেছে। এছাড়া একজন সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী পদে থাকলে দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হিসেবে থাকতে পারবেন না-এমন প্রস্তাব করেছে কমিশন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতার বিষয়ে করা সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে উল্টো পরিবারতন্ত্র আরও জেঁকে বসতে পারে। ইতিবাচকভাবে বাস্তবায়ন করলে ভালো পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু তা না করে কেউ যদি ভাবেন; তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে তার পরিবারের কাউকে দলীয় প্রধান বানাবেন, সংসদ নেতাও তার অনুগ্রাহী হবে- তখন তো পরিবারতন্ত্র আরও প্রকট হবে। তাই রাজনৈতিক ঐকমত্য খুবই জরুরি হবে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, এটা শুধু চ্যালেঞ্জের ব্যাপার নয় বরং এখানে বাস্তব বিষয়টাই হলো; সংস্কার কি হবে আর কি হবে না-সেটা ঠিক করবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ ও জনপ্রতিনিধিরা। দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ হলে সবার সব প্রস্তাব সংসদে যাবে। সেখানে এগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তারপর দেশ ও জাতির জন্য যেটা যেমন করা দরকার সংসদ তাই করবে। এজন্যই বিএনপি জুন জুলাইয়ের মধ্যেই নির্বাচন চায়।
সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার হবে সংবিধান সংশোধন করে কোন কিছু গ্রহণের জন্য। সংসদ ছাড়া এসব আলোচনার গুরুত্ব কতটা সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার বিষয়ক কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই হবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা। রাজনৈতিক দল, অন্তর্র্বতী সরকার, ছাত্ররা, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র সবার মধ্যে ঐকমত্য হতে হবে। অন্তত কৌশলগত বিষয়ে একমত হতে হবে। কারণ নির্বাচনের পর যে সরকার হবে তাকে ৫ আগস্ট থেকে হওয়া সব কিছু বৈধতা দিতে হবে। সংস্কার কর্মসূচিও রেটিফাই করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সব সংস্কার কর্মসূচির জন্যই রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি। নতুন বাংলাদেশের যে ভিশন তা নিয়ে অঙ্গীকারটাও জরুরি। না হলে এসব কিছু কাগজে-কলমে থেকে গেলেও আমি অবাক হবো না।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলছেন, বাংলাদেশে সংস্কারের প্রসঙ্গ আগেও এসেছে কিন্তু রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করেনি; বরং নিজেদের ইচ্ছেমতো সংবিধান সংশোধন করেছে। সব দল একমত হয়েছে কি-না তাও নিশ্চিত না। হয়তো সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তখন দেখা যাবে তারা একমত হতে পারেন কি-না। সব রাজনৈতিক দলের এই একতাটাই প্রথম চ্যালেঞ্জ। তবে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন নির্ভর করবে জনগণের ম্যান্ডেটের ওপর।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More