বিদেশি মদের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় বেড়েছে কেরুর চাহিদা
শুধু ডিস্ট্রিলারি ইউনিট বা মদ উৎপাদন থেকে কোম্পানির আয় ৩৬৭ কোটি টাকা
স্টাফ রিপোর্টার: নিয়ন্ত্রণের কারণে বিদেশি মদ আমদানি কমে যাওয়ায় মদ বিক্রি ও মুনাফায় রেকর্ড গড়েছে দেশের একমাত্র লাইসেন্সধারী অ্যালকোহল উৎপাদনকারী কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড। কোম্পানির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মোট বিক্রি ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে কেরু অ্যান্ড কোং আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১০ লাখ প্রুফ লিটার বেশি মদ বিক্রি করেছে। শুল্ক ফাঁকি রোধে গত বছর মদ আমদানিতে নজরদারি বাড়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে বৈধপথে মদ আমদানি হ্রাস পায়। এতে করে অনুমোদিত বারগুলোতে বিদেশি মদের সংকট দেখা দেয়। এরপর থেকেই দেশে উৎপাদিত মদের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বর্ধিত চাহিদা পূরণে কেরু অ্যান্ড কোং উৎপাদন বাড়িয়েছে। ফলে কোম্পানিটির উৎপাদিত মদ বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে মুনাফার পরিমাণও।
কোম্পানি সূত্র জানিয়েছে, শুধু ডিস্টিলারি ইউনিট বা মদ উৎপাদন থেকে তাদের আয় ৩৬৭ কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের অধীনে তত্ত্বাবধানে থাকা কেরু অ্যান্ড কোং তাদের ডিস্টিলারি ইউনিট থেকে ১০০ কোটি টাকারও বেশি মুনাফা করেছে, এটিও এবার প্রথম। আগের বছর এই সংখ্যা ছিলো প্রায় ৯০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, কেরুর চিনি ইউনিটকে বড় লোকসান গুনতে হয়েছে। তবে ঠিক কত লোকসান হয়েছে তা এখনো কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নির্ণয় করতে পারেনি। তবে চিনি উৎপাদনের লোকসান সমন্বয়ের পরও ২০২১-২২ অর্থবছরে কোম্পানির নীট মুনাফা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৭০ কোটি টাকা, যা বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিলো ১৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
কেরু অ্যান্ড কোং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোসারুফ হোসেন বলেন, ‘আগের বছরের চেয়ে এবার ২৫-৩০ শতাংশ বিক্রি বেড়েছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ কোম্পানির বিক্রি বাড়াতে সহায়ক হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বর্ধিত চাহিদা পূরণে কোম্পানির বিদ্যমান ক্যাপাসিটির ব্যবহার বেড়েছে, তারপরও একটি বড় অংশ এখানো অব্যহৃত রয়েছে। চাহিদা যদি আরও বাড়ে, বিদ্যমান ফ্যাক্টরিতে বাড়তি চাহিদা পূরণে মদ উৎপাদন সম্ভব হবে।’
১৯৩৮ সালে চুয়াডাঙ্গায় প্রতিষ্ঠিত কেরু অ্যান্ড কোং-এর বর্তমানে ৬টি ইউনিট রয়েছে: চিনি, ডিস্টিলারি, ফার্মাসিউটিক্যালস, বাণিজ্যিক খামার, আকন্দবাড়িয়া খামার (পরীক্ষামূলক) এবং জৈব সার। এর মধ্যে শুধু ডিস্টিলারি ও জৈব সার ইউনিটই লাভজনক। কোম্পানিটি আখের রসের গুড় থেকে অ্যালকোহল এবং বিভিন্ন ধরনের স্পিরিট তৈরি করে, যা চিনি উৎপাদনের উপজাত। চিনি উৎপাদনের জন্য আখের রস আহরণের পর তিনটি উপজাত পাওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে গুড়, ব্যাগাস এবং প্রেস মাড। মদ বা অ্যালকোহল উৎপাদনের প্রধান উপাদান হল গুড়। গুড়ের সাথে ইস্ট প্রক্রিয়াকরণের পরে অ্যালকোহল তৈরি করা হয়। কেরু অ্যান্ড কোং এর ডিস্টিলারি ইউনিট ৯টি ব্র্যান্ডের মদ তৈরি করে, যার মধ্যে রয়েছে ইয়েলো লেভেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্র্যান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ কুরাসাও, জারিনা ভদকা, রোজা রাম এবং ওল্ড রাম। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় কেরু অ্যান্ড কোং-এর তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সামনে কক্সবাজার ও পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটায় আরও দুটি বিক্রয়কেন্দ্র এবং আরও তিনটি গুদাম স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
সূত্র বলছে, ম্যানুয়াল সিস্টেমের পরিবর্তে অটোমেশন পদ্ধতিতে মদের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন; বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলেই উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণের আশা করছেন কর্মকর্তারা। কেরু অ্যান্ড কোং-এর ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, ১৮০৩ সালে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী জন ম্যাক্সওয়েল চোলাই মদের কারখানা (ডিস্টিলারি) হিসেবে একে প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে কারখানাটি নির্মাণ করেন তিনি। এটিই উপমহাদেশের প্রথম ডিস্টিলারি। পর্যায়ক্রমে আসানসোল, কাটনি এবং দর্শনায় (পূর্ববঙ্গ, যা ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়) কেরুর শাখা খোলা হয়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে পূর্ব পাকিস্তান রূপান্তরিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার দর্শনার ডিস্টিলারিটির জাতীয়করণ করেন; তখন থেকেই কোম্পানিটি কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড হিসেবে পরিচিত হতে থাকে।