বারান্দা-র্যাম সিঁড়িতেও জায়গা দিতে না পেরে খুলে দেয়া হলো পুরোনো দুই ওয়ার্ড
শীতের শুরুতেই রোটাভাইরাসের হানা : চুয়াডাঙ্গায় ব্যাপকহারে বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশু রোগী
আফজালুল হক:
আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে চুয়াডাঙ্গায় বেড়েছে শীতজনিত রোগ। হঠাৎ শীতের আগমনে ব্যাপকহারে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে শিশু ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা। গত ৮ দিনে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ২৮৮ জন ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ শিশু রোটা ভাইরাসে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে জায়গা না থাকায় বারান্দা, র্যাম সিঁড়িতে এমনকি হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসারের কক্ষের সামনে পর্যন্ত রোগীর ভিড় দেখা গেছে। জায়গা না পেয়ে অনেককে রাতে বাড়ি ফিরে যেতেও দেখা গেছে। রোগীর বাড়তি চাপ সামাল দিতে গতকাল শুক্রবার সকালে খুলে দেয়া হয়েছে পুরোনো দুই মেডিসিন ওয়ার্ড। রোগীদের সেখানে রেখে দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা। গতকাল রাতে দেখা গেছে পুরোনো দুই ওয়ার্ডের একটি পূর্ণ হয়ে গেছে। অন্যটিতে নতুন রোগী রাখা শুরু হয়েছে। সেবা নিশ্চিত করতে দেয়া হয়েছে অতিরিক্ত সেবিকা। অন্যদিকে শুধু হাসপাতালের আন্তঃবিভাগেই নয়, ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগির চাপ রয়েছে বহিঃবিভাগেও। বহির্বিভাগে প্রতিদিন শীতজনিত কারণে ৩০০-৪০০ শিশু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। রোটা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় অভিভাবক মহল চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। যদিও চিকিৎসকেরা বলছেন, অভিভাবকদের সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। এদিকে, গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টার চুয়াডাঙ্গা ১৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও রাত ৯টায় ২০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সামাদুল হক।
সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত ৮ দিনে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে শিশুসহ ২৮৮ রোগী। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই শিশু রোগী। গতকাল ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নতুন ৩৫ রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি থেকে ৯১ ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। কলেরা স্যালাইনসহ যাবতীয় ওষুধ সরবরাহ রয়েছে বলে জানা গেছে। চিকিৎসায় যেনো কোনো ঘাটতি না হয় সেজন্য বাড়ানো হয়েছে সেবিকাদের সংখ্যাও। এছাড়াও বহির্বিভাগে প্রতিদিন শীতজনিত কারণে ৩০০-৪০০ শিশু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে।
গতকাল রাতে সরজমিনে দেখা যায়, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের পুরোনো ভবনের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে পা ফেলার জায়গা নেই। মেঝেতে দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা। বেশির ভাগই শিশু ডায়রিয়া রোগী। মেডিসিন ওয়ার্ড নতুন ভবনে হস্তান্তর করায় ফাঁকা দুই মেডিসিন ওয়ার্ডেও ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসা সেবায় কোনো ঘাটতি না হয় সেজন্য ডায়রিয়া ওয়ার্ডে দেয়া হয়েছে অতিরিক্ত সেবিকা। সাধ্যমতো চিকিৎসা সেবা দিতে দেখা গিয়েছে। তবে হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ থাকায় রোগী ও স্বজনদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করতেও দেখা যায়। এছাড়াও চিকিৎসক এবং সেবিকাদের চিকিৎসা সেবা নিয়েও কোনো অভিযোগ করেনি কেউ। সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে।
ডায়রিয়া আক্রান্ত একাধিক শিশু রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় দৈনিক মাথাভাঙ্গার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তারা জানান, হঠাৎ করেই শিশুদের ডায়রিয়া এবং বমি শুরু হচ্ছে। বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসা করেও কম না হলে হাসপাতালে নিয়েছি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন চিন্তার কোনো কারণ নেই। শীতজনিত রোটাভাইরাসের জন্য ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, আগের তুলনায় চিকিৎসা সেবা ভালো হয়েছে। বাচ্চাদের কোনো সমস্যা হলে নার্সের ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসককে জানানো হলে তিনিও তাৎক্ষণিক এসে চিকিৎসা দিচ্ছেন। কলেরা ও খাওয়া স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ হাসপাতাল থেকেই দিচ্ছে।
জীবন নামে এক রোগী বলেন, গত পরশু সকাল ডিম ভাজি দিতে ভাত খাওয়ার পর গ্যাস্টিকের সমস্যা অনুভব করি। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে গ্যাস্টিকের ওষুধ খেয়ে কম হয়নি। দুপুর থেকে হঠাৎ শুরু হয় ডায়রিয়া। গতকাল সকালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। স্যালাইন ওষুধ কিছুই কেনা লাগেনি। সব হাসপাতাল থেকেই দিচ্ছে। চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি নেই।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত দুই বছর বয়সী শিশু রাইহানের মা জানান, হঠাৎ দুদিন যাবত বমি ও পাতলা মল হচ্ছে ছেলের। গতকাল বিকেলে হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক ভর্তি করে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে পাঠান। ওয়ার্ডে কোনো জায়গা নেই। মেঝেতেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। শীতে একটু কষ্ট হলেও চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি নেই। ডাক্তার বলেছেন রোটা ভাইরাসের কারণে পানি শূন্যতা হয়ে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছে। ২-৩ দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবে ছেলে।
হাসপাতালে স্টোর কিপার হাদিউর রহমান হাদি দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। কলেরা স্যালাইন ও খাওয়া স্যালাইনের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ আছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আসাদুর রহমান মালিক খোকন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, সদর হাসপাতালে রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া রোগী বাড়ছে। বেশিরভাগই শিশু রোগী। প্রতিদিন বহির্বিভাগে দুই শিশু চিকিৎসক প্রায় ৩০০-৪০০ শিশু রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
রোটা ভাইরাস প্রতিরোধে চিকিৎসকের পরামর্শ
ডা. আসাদুর রহমান মালিক খোকন বলেন, রোটা ভাইরাস অত্যন্ত মারাত্মক রোগ। এটি শিশুর মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। তাই কিছু লক্ষণ দেখামাত্রই দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। যেসব লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে যে রোগীর পানিশূন্যতা হয়েছে তা হলো উদ্বিগ্নতা, কান্না করলেও চোখে পানি না আসা, প্রস্রাব কমে যাওয়া বা ডায়াপার পরালে তা শুকনো থাকা, ক্লান্তি, ঠোঁট শুকনো থাকা, প্রচ- ঘুম পাওয়া, ত্বক শুষ্ক ও বিবর্ণ হওয়া।
রোটা ভাইরাস ডায়রিয়ার লক্ষণ: সাধারণত কোনো শিশু রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার দুই দিনের মধ্যেও কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এই রোগে প্রথমে জ্বর আসে, বমি শুরু হয় এবং তারপর পেট ব্যথা শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে পাতলা পায়খানা শুরু হয়। এটি প্রায় ৫ থেকে ৭ দিন থাকতে পারে। তবে বড়দের ক্ষেত্রে এটি ততটা মারাত্মক হয় না।
চিকিৎসা: ভাইরাসজনিত রোগ হওয়ায় রোটা ভাইরাস রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। রোটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই ওরাল স্যালাইনই আসল হাতিয়ার। বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। ৬ মাসের বড় বাচ্চাদের অন্যান্য খাবার দিতে হবে। নরম জাউ, কাঁচা কলা ভর্তা, ডালের পানি ইত্যাদি খাওয়াতে হবে। প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর স্যালাইন খাওয়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই রোগের আসল ঝুঁকি হলো পানিশূন্যতা।
প্রতিরোধ: প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেয়া প্রধান প্রতিরোধ। প্রতিরোধ নিরাময়ের চেয়ে শ্রেয়। ফুটানো পানি পান করা, পায়খানার পর ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, রাস্তাঘাটের খোলা খাবার পরিহার করা, বাচ্চাদের এটা-সেটা মুখে দেয়া থেকে বিরত রাখা ইত্যাদি রোটা ভাইরাস রোগের সংক্রমণে বাধা দেবে।
যেভাবে এই ভাইরাস ছড়াই: যদি কোনো শিশু রোটা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে আক্রান্ত হওয়ার দিন থেকেই অর্থাৎ লক্ষণ প্রকাশ হওয়ার আগে থেকেই শিশুটির মলে এই ভাইরাসের উপস্থিতি দেখা যায়। কোনো কারণে তা সঠিকভাবে পরিষ্কার করা না হলে বা শিশুটির হাতে পায়ে মল লেগে থাকলে এর মাধ্যমেই রোটা ভাইরাস ছড়াতে পারে। শিশুটির হাত থেকে রোটা ভাইরাস জীবাণু তার খেলনা, খাবার প্লেট যেকোনো স্থানে ছড়াতে পারে। এ থেকে অন্য যেকোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে। তাই শৌচকাজ সারার পর ছোট থেকে বড় সবারই ভালোভাবে জীবালু মুক্তকরণ সাবান দিয়ে হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি। গ্রামাঞ্চলে যেখানে এখনো টয়লেট নেই, সেখানে এ রোগ ছড়ানোর হার অত্যন্ত বেশি। রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুর মল কারও কাপড়, জুতো বা পায়ে লেগেও ছড়াতে পারে।
যাদের এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে: এই রোগ সাধারণত শিশুদের মধ্যেই বেশি দেখা দেয়। তবে আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গে যারা থাকে বিশেষ করে শিশুর মা বাবা, ভাই বোন বা অন্যান্য আত্মীয় কিংবা ডে কেয়ারের কর্মচারীদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।