স্টাফ রিপোর্টার: করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে সারা দেশে শুরু হয়েছে ৭ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ। আজ ভোর ৬টা থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত এটি বলবৎ থাকবে। এ সময়ে জরুরি সেবা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিস, গণপরিবহণসহ যন্ত্রচালিত সব ধরনের যানবাহন, শপিংমল-দোকানপাট বন্ধ থাকবে। তবে শিল্পকারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু রাখা যাবে। জনসমাবেশ হয় এমন কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে না। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হলেই গ্রেফতার করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যারা করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার তারিখ পেয়েছেন, তারা টিকা কার্ড দেখিয়ে কেন্দ্রে যেতে পারবেন। বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থলবন্দর এবং সংশ্লিষ্ট অফিস নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বুধবার এসব বিষয়সহ ২১ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। সারাদেশে দোকানপাট সকাল ৯টা থেকে বিকেলে ৫টা পর্যন্ত খোলা রাখা গেলেও চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দোকানপাট খোলা রাখার সিন্ধান্ত নিয়েছে। এ বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে পুলিশ, বিজিবির পাশপাশি সেনাটহল থাকবে। এছাড়াও ম্যাজিস্ট্রটগণ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন।
সারাদশের এসব বিধিনিষেধ কঠোরভাবে বাস্তবায়নে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসারসহ সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, চলাচলে বিধিনিষেধ কার্যকর করার জন্য ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন থাকবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয়ভাবে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করবেন।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারে জানিয়েছে, বিধিনিষেধ চলাকালে ব্যাংকিং সেবা শুক্র, শনি সাপ্তাহিক ছুটির পাশাপাশি রোববারও বন্ধ থাকবে। বাকি খোলার দিনে ব্যাংকের লেনদেন হবে সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করাসহ মসজিদে নামাজের বিষয়ে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যে ২১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে, সেগুলো হচ্ছে- ১. সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। ২. সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহণ (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সবপ্রকার যন্ত্রচালিত যানবাহন বন্ধ থাকবে। ৩. শপিংমল/মার্কেটসহ সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে। ৪. সব পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকবে। ৫. জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান-ওয়ালিমা, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি), রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ৬. বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট আদালতগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে। ৭. ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে। ৮. আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন- কৃষি পণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহণ, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত কার্যাবলি, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবা, ব্যাংক, ফার্মেসি ও ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে যাতায়াত করতে পারবে। ৯. পণ্য পরিবহণে নিয়োজিত ট্রাক/লরি/কাভার্ড ভ্যান/কার্গো ভেসেল এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে। ১০. বন্দরসমূহ (বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল) এবং তৎসংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে। ১১. শিল্পকারখানাসমূহ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। ১২. কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন/বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে। ১৩. অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ১৪. টিকা কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে। ১৫. খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রয় (অনলাইন/টেকওয়ে) করতে পারবে। ১৬. আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে এবং বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকিট প্রদর্শন করে গাড়ি ব্যবহারপূর্বক যাতায়াত করতে পারবে। ১৭. স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে মসজিদে নামাজের বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দেবে। ১৮. ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠপর্যায়ে কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয়সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। ১৯. জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও আনসার নিয়োগ ও টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি ও সময় নির্ধারণ করবেন। সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগসমূহ এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে। ২০. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয়সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে এবং ২১. স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করবেন।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর গত বছর মার্চের শেষ দিকে সরকার সাধারণ ছুটির আদলে লকডাউন জারি করে, যা মে মাস পর্যন্ত ছিলো। এর মধ্যে সংক্রমণের হার কমে যাওয়ায় বিধিনিষেধও শিথিলতা আসে। ২০২১ সালের শুরুতে সংক্রমণের নি¤œগতিতে বিধিনিষেধ ছিলো না বললেও চলে। এ সময় স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার পরিকল্পনাও সরকার করেছিলো। কিন্তু মার্চের শেষে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ পরিস্থিতি নাজুক করে তুললে এপ্রিলে সারা দেশে লকডাউনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও তা ছিলো আগের বছরের তুলনায় শিথিল। পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতিতে সেই বিধিনিষেধ শিথিল করা হলেও করোনাভাইরাসের ভারতে সংক্রমিত ডেল্টা ধরনে সীমান্ত জেলাগুলোতে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। স্থানীয় পর্যায়ে লকডাউন দিলেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশে টানা ১৪ দিন ‘সম্পূর্ণ শাটডাউন’ ঘোষণার সুপারিশ করে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটি। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ জুন থেকে ৩ দিনের সীমিত বিধিনিষেধ দেয় সরকার। সেই বিধিনিষেধের মেয়াদ আজ ভোর ৬টায় শেষ হয়। এরপর নতুন করে কঠোর বিধিনিষেধ দিলো সরকার।