বন্ধুর মাকে অপমান করার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে খুন হন দুই যুবক

চুয়াডাঙ্গার ভালাইপুরে জোড়া খুনের ঘটনায় দুজন গ্রেফতার : পাশাপাশি দাফন

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গার ভালাইপুরে জোড়া খুনের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে নিহত মামুনুর রশিদের ভাই স্বপন আলী বাদী হয়ে ১৫জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১৫ জনের বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এর আগে সকালে অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুজনকে চুয়াডাঙ্গা সদরের আলুকদিয়া থেকে আটক করে পুলিশ। মামলার পর আটক দুজনকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। এদিকে, নিহত সজল আহমেদ ও মামুন অর রশিদের জানাজা শেষে পাশাপাশি দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

গ্রেফতারকৃত দুজন

এলাকাবাসীসূত্রে জানা গেছে, দোকানের কর্মচারী রিয়ন প্রতি গজ ছিটকাপড়ের দাম চেয়েছিলেন ৮৫ টাকা। ক্রেতা ছামেনা বেগম দিতে চেয়েছিলেন ৮০ টাকা। দরদাম করায় ছামেনা বেগমকে অপমান করে দোকান থেকে বের করে দেন ওই কর্মচারী। আর বন্ধুর মায়ের এমন অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়েই খুন হন সজল আহমেদ ও মামুন অর রশিদ নামের দুই যুবক। বুধবার সকালে অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুজনকে চুয়াডাঙ্গা সদরের আলুকদিয়া থেকে আটক করে পুলিশ। বিকেলে নিহত মামুনুর রশিদের ভাই স্বপন আলী বাদী হয়ে ১৫জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১৫ জনের বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হুচুকপাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে আকাশ আলী (২৮), উসমান আলীর ছেলে ছানোয়ার হোসেন (৫০), মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে বাধন আলী (২১), ঝোড়াঘাটা গ্রামের মুছা করিমের ছেলে সোহেল রানা শান্তি (৪৫), হুচুকপাড়া গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে মানিক হোসেন (২০), মৃত তৈয়ব আলীর ছেলে আমিন (৩০), হৈচুদ্দীনের ছেলে রিয়ন (২০), মৃত কেসমত আলীর ছেলে সাজে (৩৭), তারাচাঁদের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন (৩৫), খবির উদ্দীনের ছেলে মিঠু রহমান (২০), আলাউদ্দীনের ছেলে রতন আলী (৩০), দামুড়হুদা উপজেলার কলাবাড়ী গ্রামের রূপচাঁদের ছেলে আশরাফুল ইসলাম (২৮), হুচুকপাড়া গ্রামের মনোয়ার হোসেনের ছেলে ইভন (১৯), আশাদুল ইসলামের ছেলে বিপ্লব হোসেন বিক্রম (২০), মিলন হোসেনের ছেলে হৃদয় (২৭)। মামলার পর আটক দুজনকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। গ্রেফারকৃতরা হলেন, চুয়াডাঙ্গা সদরের আলুকদিয়া ইউনিয়নের হুচুকপাড়ার আব্দুল খালেকের ছেলে মানিক হোসেন (১৯) ও একই এলাকার খবির উদ্দীনের ছেলে মিঠু রহমান (১৮)।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ভালাইপুর বাজারে গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে এই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। সরেজমিন অনুসন্ধান এবং পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জোড়া খুনের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার রাতের জোড়া খুনের পর সদর উপজেলার ভালাইপুর বাজারের চিরচেনা দৃশ্য বদলে গেছে। এই বাজারেরই ম-ল মার্কেটে আশরাফুল বস্ত্রালয় অ্যান্ড গার্মেন্টসে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই খুন হয়েছেন সজল ও মামুন। সাধারণত যে বাজারটিতে প্রতিদিন ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাঁচামালের জমজমাট বেচাকেনা চলে, সেখানে বুধবার সাপ্তাহিক হাটের দিনেও অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিলো।

বাজারের যেসব দোকান বুধবার খুলেছে, সেসব দোকানের মালিক-কর্মচারী এবং বাজারে আসা সাধারণ মানুষের মধ্যে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। জোড়া খুনের প্রসঙ্গে বাজারের ব্যবসায়ীদের কেউই সরাসরি মন্তব্য রাজি হননি। জোড়া খুনের প্রতিশোধ হিসেবে হামলার শিকার হওয়ার এবং পুলিশি হয়রানির আশঙ্কা রয়েছে তাদের মনে। ঘটনাস্থল ও আশপাশে পোশাক পরে এবং সাদা পোশাকে বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়ে।

জোড়া খুনের পর কারণ হিসেবে সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে ভালাইপুর বাজারের আশরাফুল বস্ত্রালয় অ্যান্ড গার্মেন্টসে গৃহবধূ ছামেনা খাতুনের ছিটকাপড় কিনতে যাওয়া ও দরদাম করায় অপমান করে বের করে দেয়ার বিষয়টি। বুধবার সকালে ভালাইপুর গ্রামের বাড়িতে কথা হয় ছামেনা খাতুনের সঙ্গে। ছামেনা জানান, মঙ্গলবার বিকেলে দোকানটিতে তিনি ছিটকাপড় কিনতে যান। একটি ছিটকাপড় পছন্দ হলে দোকানের কর্মচারী রিয়ন প্রতি গজ ৮৫ টাকা করে দাম চান। ছামেনা ৮০ টাকা করে দিতে চাইলে ওই কর্মচারী মাররুখী আচরণ করেন এবং তাকে (ছামেনা) অপমান করে দোকান থেকে বের করে দেন। সে সময় দোকানমালিক আশরাফুল দোকানে ছিলেন না। এরপর ছামেনা খাতুন বাড়িতে যান এবং ছেলে টিপু সুলতানকে বিষয়টি জানান। এ ঘটনা শুনে টিপু সুলতান সন্ধ্যায় ওই দোকানে যান এবং দোকানের মালিকের উপস্থিতিতে কর্মচারী রিয়ন ওই ঘটনায় মাফ চাইলে তা মীমাংসা হয়ে যায়।

ছামেনা খাতুনের অপমানের বিষয়টি জানতে পেরে টিপু সুলতানের বন্ধু সজল ও মামুন তাদের বাড়িতে ছুটে আসেন। এরপর তারা আরও কয়েকজনকে নিয়ে রাতেই সদর উপজেলার হুচুকপাড়া গ্রামে গিয়ে ওই দোকানের কর্মচারী রিয়নকে মোটরসাইকেলে করে তুলে নিয়ে আসেন। ভালাইপুর বাজারে পৌঁছুলে হুচুকপাড়ার আলাউদ্দিনের ছেলে আকাশ, মুছা করিমের ছেলে শান্তি মিয়া, ওসমান গনির ছেলে সানোয়ার হোসেন, জাহাঙ্গীরসহ একদল লোক তাদের গতিরোধ করেন। এ সময় কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তারা ধারালো অস্ত্র নিয়ে সজল ও মামুনের ওপর হামলা চালান। ধারালো অস্ত্রের এলোপাতাড়ি কোপে সজলের পেট ও মামুনের বুক ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।

স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আহত ব্যক্তিদেরকে মুমূর্ষুবস্থায় উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়। জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক হাসানুর রহমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সজল আহমেদকে তাৎক্ষণিক মৃত ঘোষণা করেন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মামুন অর রশিদও মারা যান।

এদিকে, বুধবার সকালে সজলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দেড় বছরের শিশু রাফিনের কান্না যেন কোনোভাবেই থামছে না। গত মঙ্গলবার রাতে ছুরিকাঘাতে নিহত সজল আহমেদের একমাত্র সন্তান রাফিন। মা জেসমিন খাতুনের কোলে অনবরত কেঁদেই চলেছে শিশু রাফিন। জেসমিন জানান, তিন বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। স্বামী সজল পেশায় ছিলেন আলমসাধু চালক। বাবার খুবই ভক্ত রাফিন। মঙ্গলবার রাত থেকে বাবাকে না পেয়ে একবার ঘরে ঢুকছে এবং বাড়ির উঠোনে রাখা আলমসাধুর কাছে গিয়ে বাবাকে খুঁজছে আর অনবরত কাঁদছে।

জেসমিন বলেন, ‘লোকটা মঙ্গলবার দুপুরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ছেলেটাও বাপের পেছনে পেছনে রাস্তা পর্যন্ত যায়। ছেলেকে দেখিয়ে সে আমার বলে যে রাফিনের ভালো করে দেখে রেখ। কদিন ধরে আমার শরীর খারাপ। বিকেলে ফোন করে বললো রাতে বাড়ি আসার সময় ওষুধ নিয়ে আসবে। তার আর বাড়ি ফেরা হলো না।’ সজলের বাবা আমজাদ হোসেন জানান, চার সদস্যের পরিবারে সজল ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার অকালমৃত্যুতে গোটা পরিবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলো। আমজাদ বলেন, ‘সামান্য কারণে আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই, জীবনের বদলে জীবন চাই।’

এদিকে, উপার্জনক্ষম সন্তান মামুনকে হারিয়ে আবদুল আজিজ-মমতাজ বেগম দম্পতি দিশাহারা। স্নাতক পাস মামুন অর রশিদ (২৪) চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় একটি এনজিওতে কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। বুধবার সকালে সরেজমিন কয়রাডাঙ্গা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলে হারানোর শোকে মুহ্যমান বাবা আবদুল আজিজ। মা মমতাজ বেগমকে ঘিরে থাকা স্বজনেরা সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নিজেদেরকে বুঝ দেয়ার ভাষা ভুলে গেছেন মামুনের মা-বাবা।

আবদুল আজিজ বলেন, চাকরির পাশাপাশি কৃষিকাজেও সহযোগিতা করতেন মামুন। এমনকি মঙ্গলবার বিকেলেও মাঠ থেকে ঘাস কেটে এনে গরুকে খাইয়েছেন। ছোট ছেলে হওয়ায় তিনি ছিলেন সবার আদরের, নয়নের মণি। চাকরিতে ঢোকার পর তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মেশার তেমন সময় পেতেন না। মঙ্গলবার বিকেলে বাড়ি থেকে যাওয়াটাই যে শেষ যাওয়া, তা বুঝতে পারেননি।

মামুন অর রশিদের মা মমতাজ বেগম বলেন, ‘অনেক কষ্টে সন্তান মানুষ করেছি। সোনার টুকরো ছেলের কারণে সেই সংসারে এখন অনেক সুখ। সেই সুখ আমার সোনার কপালে সহ্য হলো না। আমার বুকের ধনকে যারা খুন করেছে, তাদের বিচার চাই, ফাঁসি চাই।’

জোড়া খুনের ঘটনায় ঘটনাস্থলসহ ভালাইপুর বাজার ও আশপাশের এলাকায় পুলিশের তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে ভালাইপুর বাজার এবং আশপাশের এলাকায় পোশাকে ও শাদা পোশাকে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ সুপার আবদুলল্লাহ আল মামুন, সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামানসহ কর্মকর্তারা রাতেই সরেজমিন পরিদর্শন ও অভিযানে নেতৃত্ব দেন।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহাব্বুর রহমান বলেন, জোড়া খুনের ঘটনায় বিকেলে নিহত মামুনের ভাই স্বপন আলী বাদী হয়ে ১৫ জনের নাম উল্লেখ্যসহ আরও ১০-১৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলায় সকালে আটক দুজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

এর আগে দুপুরে নিহত ব্যক্তিদের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে বেলা আড়াইটার দিকে তাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। বিকেলে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছুলে গ্রামজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। একনজর দেখতে হাজারো মানুষ ভিড় করেন। বাদ মাগরিব হাজারো মুসল্লিদের অংশগ্রহণে আলমডাঙ্গা উপজেলার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের ফুটবলমাঠ প্রাঙ্গণে দুই বন্ধুর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরে গ্রামের এতিমখানা মাদরাসা কবরস্থানে দুই বন্ধুকে পাশাপাশি দাফন করা হয়।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More