আলমডাঙ্গা ব্যুরো: ‘আমাগের সংসারের আর সচ্ছলতা ফিরানো লাগবে না। তুই ফিরে আই বাজান, ফিরে আই! আমার নাড়ি ছেঁড়া ধনরে আপনারা আনি দেন।’ এসব কথা বলে আর্তনাদ করে চলেছেন চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের অভাগা মা মোমেনা খাতুন। আদরের ছেলে বকুল হোসেনের (২৫) আহত হবার খবর পাওয়ার পর অবিরাম কেঁদে চলেছেন তিনি। লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মিজদা শহরে গত বৃহস্পতিবার ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসীকে হত্যা করা হয় এবং এ ঘটনায় আহত হন ১১ বাংলাদেশী। আহতদের মধ্যে একজন বকুল হোসেন। শনিবার দুপুরে খেজুরতলা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, আদরের বকুল হোসেনের আহত হবার খবর পেয়ে মা মোমেনা খাতুনসহ পরিবারের সদস্যরা সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তাকে জীবিত অবস্থায় এক নজর দেখার আকাক্সক্ষায় তাদের আহাজারি যেনো কিছুতেই থামছে না। এলাকার শত শত নারী পুরুষ ছুটে এসেছে তাদের সান্ত¡না দেয়ার জন্য।
গ্রামের অনেকই ভাগ্য বদলের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। তাদের স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। তাদের দেখাদেখি বকুল হোসেন গত বছর লিবিয়া যান। সেখানে ভালোই ছিলেন। কাজ করছিলেন, বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছিলেন। পরিবারে আসতে শুরু করেছিলো আর্থিক স্বচ্ছলতা। এর মাঝেই গত বৃহস্পতিবার ঘটে যায় দুর্ঘটনা। দুর্বৃত্তরের গুলিতে আহত হয়ে ত্রিপলীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বকুল হোসেন। বর্তমানে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। বকুল হোসেন (২৫) চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের বাজারপাড়ার দিনমজুর হাসান আলীর ছোট ছেলে।
আহত বকুল হোসেনের মা মোমেনা খাতুন বলেন, ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বকুল হোসেন স্থানীয় দালালের মাধ্যমে লিবিয়া যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যায়। কয়েক দিন ঢাকায় থাকার পর তিনি লিবিয়ার উদ্দেশ্য রওনা হন। বকুলের বিদেশ যাওয়ার আগ্রাহ তৈরি হয় গ্রামের অনেকে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন বিদেশ গিয়ে। টাকা উপার্জন করেছেন তারা, বাড়ি তৈরি ও গ্রামে জমি কিনেছেন। সেই স্বপ্ন নিয়েই বিদেশ যায় সে। দরিদ্র পিতার কষ্ট লাঘব করতেই বিদেশ যাওয়া। লিবিয়া গিয়ে বেশ ভালোই ছিলেন তিনি। ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ করে লিবিয়া যাওয়ার জন্য চুক্তি করেন দালালের সাথে। বকুল হোসেনের সাথে লিবিয়া গিয়েছিলো তার এক মামাতো ভাই, এক ফুপাতো ভাই এবং এক খালাতো ভাই। ফরিদপুর জেলার দালাল বক্কর সরদারের মাধ্যমে লিবিয়া যায় কাজের সন্ধানে বকুল। সেখানে যাওয়ার পর উপার্জনের টাকাও তিনবার বাড়িতে পাঠিয়েছেন। আর টাকা জমিয়ে ইউরোপের দেশ ইতালিতে যাওয়ার স্বপ্ন ছিলো বকুল হোসেনের। মানবপাচারকারী চক্রের মাধ্যমে ইতালিতে যাওয়ার পথে তাদের অপহরণ করে একটি চক্র। ওই চক্রটি তাদের একটি ঘরে আটকে রেখে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করে। দাবিকৃত মুক্তিপণের টাকা না দেয়ায় সেখানে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা তাদের ওপর গুলি চালালে ২৬ বাংলাদেশী মারা যান এবং ১১ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে বাপ্পী ও বকুল চুয়াডাঙ্গার। বকুলের বিস্তারিত পরিচয় জানা গেলেও বাপ্পীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তিনি আরও জানান, গত ২০ মে রাতে বকুল লিবিয়া থেকে বাড়িতে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। সে বলে মা আমরা ভালো নেই। অপহরণের পর আমাদের একটি ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। আমি যেনো বন্দিশালা থেকে মুক্ত হতে পারি সে দোয়া করো। এর বেশি মায়ের সাথে কথা হয়নি বকুলের। ছেলের আহত হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকে মায়ের কান্নায় গ্রাম জুড়ে নীরবতা নেমে এসেছে। ছেলের কথা বলতে বলতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা মোমেনা খাতুন। তিনি চিৎকার করে কাঁদছেন আর বলছেন, ‘ফিরে আই বাজান, আমার নাড়ি ছেঁড়া ধনরে।’
আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দারুস সালাম বলেন, কয়েক মাস আগে সে দালালের মাধ্যমে বিদেশ যায়। বিদেশ যাওয়ার আগে মাকে বলে টাকা দেয়ার সময় চেয়ারম্যানকে জানাতে। লিবিয়া পৌঁছানোর পর তার মা চেয়ারম্যানকে সাথে নিয়ে দালালের ব্যাংক হিসাবে টাকা দেন।
আলমডাঙ্গা থানার ওসি আলমগীর কবির জানান, লিবিয়ায় আহত যুবকের বাড়িতে আমি লোক পাঠিয়েছি খবর নেয়ার জন্য। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।