পাঠ্যবইয়ের ‘হাহাকার’ দূর হতে আর কতো অপেক্ষা
নতুন শ্রেণির সব বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ‘দিশেহারা’
স্টাফ রিপোর্টার: জানুয়ারি গড়িয়ে চলছে শিক্ষাবর্ষের দ্বিতীয় মাস। এখনো নতুন শ্রেণির সব বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ‘দিশেহারা’। বইয়ের জন্য ‘হাহাকার’ দূর করতে তাদের আরও অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছে সরকার ও মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা। এবার ৪০ কোটি ১৫ লাখ কপি বই ছাপানোর কথা। ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংখ্যার বিবেচনায় অর্ধেক বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো গেছে। তবে সব বিষয়ের সব বই এখনও তারা হাতে পাননি। প্রাথমিকের ৮০ শতাংশ বই শিক্ষার্থীদের হাতে গেছে। আর মাধ্যমিকের ৬০ শতাংশ বইয়ের অপেক্ষায় আছেন শিক্ষার্থীরা। ‘ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে সব বই শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে’ বলে পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণ তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্তারা আশ্বস্ত করলেও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মাস গড়িয়ে মার্চে গিয়ে বইয়ের অপেক্ষা মিটতে পারে। গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর পাঠ্যক্রম বদলে বই পরিমার্জন করে ছাপার কাজ শুরু করতে সময় লাগায় বছরের শুরুতে বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া যায়নি বলে দাবি এনসিটিবির। উচ্চবিত্ত অভিভাবকরা এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা বইয়ের পিডিএফ প্রিন্ট করে কাজ চালাতে পারলেও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের সে সুযোগ হয়নি। কারণ, শ্রেণিভেদে প্রতি সেট বই প্রিন্ট করতে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আর সব বই হাতে না পাওয়ায় মফস্বল এলাকার স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমেছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা, যা ঝরে পড়ার হার বাড়াবে বলে আশঙ্কা তৈরি করছে।
এনসিটিবির তথ্য বলছে, ৪০ কোটি ১৫ লাখ কপি বইয়ের মধ্যে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের হাতে মাত্র ১৯ কোটি ৪৯ লাখ কপি পৌঁছেছে। প্রাথমিক পর্যায়ের ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার কপি বইয়ের মধ্যে ৭ কোটি ৩৯ লাখ ২৭ হাজার কপি পৌঁছেছে শিক্ষার্থীদের হাতে। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের ৩০ কোটি ৯৬ লাখ কপি বইয়ের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ বা ১২ কোটি ১০ লাখ ৪৫ হাজার কপি হাতে পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আবু নাসের টুকু বলেন, “প্রাথমিক পর্যায়ে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার কপি বইয়ের মধ্যে ৭ কোটি ৩৯ লাখ কপি মঙ্গলবার পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রাথমিকের বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেছে ৮০ শতাংশের বেশি।” প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বেশিরভাগ বই শিক্ষার্থীরা হাতে পেয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এ তিন শ্রেণির প্রথম ৭০টি লটের সব বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব শ্রেণির বাকি ২৭টি লটের ৮৭ শতাংশ বইও চলে গেছে। প্রাকপ্রাথমিকের ২০ শতাংশ, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ৪০ শতাংশ ও এবতেদায়ী পর্যায়ের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রায় ৪০ শতাংশ বই প্রস্তুত হচ্ছে। আমরা আশা করছি আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পারব।” এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ের ৩০ কোটি ৯৬ লাখ বইয়ের মধ্যে ১২ কোটি ১০ লাখ ৪৫ হাজার কপি উপজেলা পর্যায়ের পৌঁছেছে। ছাপানো শেষ হয়েছে ১৫ কোটি ২০ লাখ ২৭ হাজার কপি। “দশম শ্রেণির সব বই পৌঁছে গেছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির তিনটি বই আগে পাঠানো হয়েছিল, বাকিগুলোর কাজ চলছে। আর নবম শ্রেণির কিছু বইয়ের কাজ বাকি আছে। আমরা আশা করছি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়া যাবে।” প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীর প্রায় সব বই পেয়েছে বলে এনসিটিবি দাবি করলেও অন্যান্য শ্রেণিগুলোতে বই মিলেছে দুই বা তিনটি। একজন অভিভাবক নাজনিন মহলের দুই ছেলেমেয়ে দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে, দুজনই ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিনি বলেছেন, মেয়ে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই পেলেও ছেলে শুধু বাংলা বই পেয়েছে। শিক্ষাবর্ষের দ্বিতীয় মাসে এসেও সন্তানরা বই না পাওয়ায় দুশ্চিন্তায় তিনি। তিনি বলেন, “বই না পাওয়ায় ওরা পিছিয়ে পড়ছে। বই নেই তাই পড়তেও বসতে চায় না। তাই এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে বইয়ের পিডিএফ নামিয়ে প্রিন্ট করিয়ে নেয়ার কথা ভাবছি। কিন্তু প্রতি সেট বই প্রিন্ট করতে সাড়ে চার হাজার টাকা লাগছে। আমরা প্রিন্ট করিয়ে নিতে পারলেও যাদের সে সামর্থ্য নেই, সেই বাচ্চারা বিপদে পড়বে।”
নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তহমিনা বেগম বলেন, “বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই পেলেও অন্যান্য বই এখনও দেওয়া হয়নি। নবম শ্রেণি বিভাগ বিভাজনের প্রথম বছর, তাই পিছিয়ে পড়ার ভয় আছে। কিছু কিছু অংশ প্রিন্ট করিয়ে কাজ চালাচ্ছি।”
একটি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. হাবিবুল্লাহ রাজু বলেছেন, তাদের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তিনটি বিষয়ের বই পেলেও অন্যগুলো পায়নি। আর নবম ও দশম শ্রেণির বিজ্ঞান, ব্যাবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীরা কেউ তিনটি, কেউ দুটি বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বই পেয়েছে। “তবে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিভাগভিত্তিক কোনো বই পায়নি। বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুল আসতে চায় না। ক্লাসে উপস্থিতি খুবই কম।”
‘বাংলাদেশ শিক্ষক ফোরাম (বাশিফ)’ নামে একটি সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বে থাকা এই শিক্ষক বলেন, “বই না পেয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে না আসা ঝরে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। পদার্থবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, গণিত, বিজ্ঞানের মত বইগুলোতে খুব বেশি পরিমার্জন করা হয়নি। এ বইগুলো আগেভাগে ছাপিয়ে দিতে পারলে সংকট কিছুটা কমত।” এনসিটিবির কর্মকর্তারা ফেব্রুয়ারি মাঝামাঝিতে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিলেও এ অপেক্ষা আরও কিছুটা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণির বইয়ের ছাপাখানা রূপালি প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্ত্বাধিকারী, মুদ্রণ শিল্প সমিতি এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, “যে গতিতে বর্তমানে কাজ চলছে তাতে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ শিক্ষার্থীরা সব বই হাতে পাবে। বই পরিমার্জনের সময় লাগায় এবার ছাপানো শুরু হয়েছে দেরিতে, আগে জুলাই মাসে ছাপার কাজ শুরু হলেও এবার তা হয়েছে ডিসেম্বরে। তাই এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, “বর্তমানে কাগজের সংকট আছে, কাগজ আমদানিতে এনসিটিবি আমাদের সহায়তা করছে। সেই কাগজ ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি দেশে পৌঁছানোর কথা আছে। সে কাগজ যদি তিন কিস্তিতে আমাদের দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে আমরা সব কাগজ পাব। “অপরদিকে পরিবর্তিত কারিকুলামের নোট-গাইডের চাহিদা আছে। নোট-গাইড প্রস্তুতকারকদের তৎপরতায় আমরা শ্রমিক সংকটে আছি। তারা আমাদের শ্রমিকদের দিয়ে রাতের শিফটে নোট-গাইডের কাজ করাচ্ছে। ফলে শ্রমিকরা ওই দিকে মনযোগী। কাগজ ও শ্রমিক সংকটে পুরোদমে কাজ চলানো যাচ্ছে না।” ব্যাংকঋণ পাওয়া নিয়েও সংকটে থাকার বলেন তিনি। “ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের কথা বলে আমাদের লোনের টাকা ছাড় করছে না। এক্ষেত্রে এনসিটিবি আমাদের সহায়তা করছে, বোর্ড ব্যাংকগুলো সঙ্গে কথা বলে আমাদের ৪০ কোটি টাকা লোন ছাড় তরান্বিত করেছে, যেটিকে আমি সাধুবাদ জানাই।” তবে সংকট ঘনীভূত হলে বইয়ের অপেক্ষা আরও বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তোফায়েল খান বলেন, “সঠিক সময়ে কাগজ হাতে পেলে, তারল্য ও শ্রমিক সংকট নিরসন করা গেলে আমরা মার্চের প্রথম সপ্তাহে আমরা সব বইয়ের কাজ শেষ করতে পারব। আর সংকট যদি ঘণীভূত হয় তাহলে বই ছাপার কাজ পুরোপুরি শেষ করতে মার্চ মাসের পুরোটা লেগে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এপ্রিল পর্যন্ত বাড়বে বইয়ের অপেক্ষা।” প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বই ছাপানোর দায়িত্ব পাওয়া লেটার এন কালারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ সিরাজ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব সংকট মোকাবিলা করে আমরা কাজ চালাচ্ছি। আশা করছি মার্চের শুরুতে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া যাবে।” ফেব্রুয়ারিতেই বই পৌঁছাতে নানা উদ্যোগ অবসরে যাওয়ার সুবিধার্থে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসানকে গত ২৬ জানুয়ারি প্রত্যাহার করা হলেও বই নিয়ে সংকটের কারণে তার মেয়াদ আরও দুই মাস বাড়িয়েছে সরকার। এদিকে বই ছাপানোর কাজ তরান্বিত করতে ঋণের অর্থ ছাড়, কাগজ আমদানিতে সহায়তা ও নোট-গাইডের বিরুদ্ধে সরকার শক্ত অবস্থান নিয়েছে।
অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, “আমরা প্রকাশকদের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত কাজ শেষ করতে চাই। তাদের আর্ট পেপারের সংকট ছিল, সরকারি উদ্যোগে তা মেটানো হয়েছে। তাদের ঋণের টাকা ছাড়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আমরা কথা বলছি। কাগজ আমদানিতে সহায়তা করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।” প্রকাশকরা আন্তরিক হলে ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো ‘সম্ভব’ বলে মনে করেন তিনি। অধ্যাপক রিয়াজুল বলেন, “প্রকাশকরা যে দেরির কথা বলছেন তা ঠিক না। তারা চাইলে আর একটু আন্তরিক হলে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সব বই পাঠানো যাবে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণির সব বই পৌঁছে গেছে। প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ফেব্রুয়ারির শুরুতেই পাঠানো যাবে। আর ষষ্ঠ, সপ্তম ও নবম শ্রেণির কিছু বই শিক্ষার্থীরা পেয়েছে, বাকিগুলো ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাঠানো সম্ভব হবে।”
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.