দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি অবহিত করতে ইসির সঙ্গে ২৬ দলের বৈঠক

ভালো পরিবেশ আছে দাবি আ.লীগের : সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা অন্যদের
আমরা স্বীকার করেছি পরিবেশ অনুকূল নয়-সিইসি : সংলাপে বিএনপিসহ ১৮ দল
স্টাফ রিপোর্টার: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছে ইসির আলোচনায় অংশ নেয়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। আলোচনা সভা শেষে কমপক্ষে ১১টি দলের নেতারা প্রকাশ্যেই সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। পরিবেশ অনুকূলে না আসায় আগামী নির্বাচনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ভোটগ্রহণ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন তাদের কেউ কেউ। তারা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন, রাজনৈতিক সমঝোতার আগে তফশিল ঘোষণা না করা, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ইসিকে পদক্ষেপ নেয়াসহ বেশ কিছু প্রস্তাবও করেন। গতকাল শনিবার ৪৪টি দলের মধ্যে ২৬টি অংশ নিয়েছে। বিএনপিসহ ১৮টি দল ইসির ডাকে সাড়া দেয়নি। সকালে ১৩টি দলের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা ও বিকালে ১৩ দলের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক হয়। এ সভায় সিইসির সভাপতিত্বে চার নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে তফসিল দেয়ার কথা রয়েছে সংসদ নির্বাচনের। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আসন্ন ভোটের পরিবেশ ভালো রয়েছে দাবি করলেও নির্বাচন কমিশনের আলোচনায় এসে কিছু দল অনুকূল পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো কোনো নির্বাচন দেশে দেখতে চান না। দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবরোধ চলছে সেটি সুষ্ঠু নিবাচনের অন্তরায়। সকাল ও বিকালে ইসির সঙ্গে আলোচনা শেষে দলের প্রতিনিধিরা গণমাধ্যমে ব্রিফিং করেন।
নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংকট নিরসন করার সামর্থ্য আমাদের (ইসি) নেই বা আমাদের সেই ম্যান্ডেটও নেই। যদিও আলোচনায় আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আছে। আগামীতে এটা আরও ভালো হবে। বিএনপি সহিংসতা করছে। বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা সংবিধানে নেই বলেও জানান তারা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি অবহিত করতে গতকাল শনিবার নির্বাচন ভবনে সিইসির সভাপতিত্বে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ও বিকাল দুই ধাপে ২২টি করে মোট ৪৪টি নিবন্ধিত দলকে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানায় ইসি। এতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ মোট ২৬টি দল অংশ নেয়। প্রতিটি দলের দুজন করে প্রতিনিধি আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ১৮টি রাজনৈতিক দল ইসির এ আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। এর আগে গত বছর অনুষ্ঠিত সংলাপেও বিএনপিসহ ৯টি দল অংশ নেয়নি।
ইসির সঙ্গে আলোচনায় অন্তত ১১টি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অনুকূল পরিবেশ না থাকার কথা জানিয়েছেন। দলগুলো হচ্ছে-জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ), তৃণমূল বিএনপি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল)।
এ বিষয়ে আলোচনা সভার পরে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ২৬টি দল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছে। আলোচনা যথেষ্ট ইতিবাচক ছিল। তারপরও পরিবেশ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, নির্বাচনের পরিবেশটা অনুকূল নয়। কিছু কিছু দল এখনো অংশ নিতে পারছে না। আমরা সেটা স্বীকার করেছি। বলেছি, পরিবেশ অনুকূল-প্রতিকূল হওয়ার বিষয়টা আপেক্ষিক।
রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনীতিবিদদের করতে হবে-এ কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়ে সিইসি বলেন, রাজনৈতিক যে সংকট আছে, সেগুলো সম্পর্কে আমাদের প্রত্যাশা সবসময় ইতিবাচক। কিন্তু সেই সংকট নিরসন করার সামর্থ্য আমাদের নেই বা আমাদের সেই ম্যান্ডেটও নেই। আমরা ওনাদেরকে বলেছি আপনারাও নিজেদের মধ্যে এই চেষ্টাটা করতে পারতেন। নির্বাচন বিষয়ে আমাদের রাজনীতিতে বিদেশিরা এসে অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন অথচ আপনারা সমাধান দিতে পারছেন না। আপনারাও তো রাজনৈতিক নেতা হিসাবে নেতৃবৃন্দ হিসাবে এই দায়িত্বগুলো নিতে পারতেন। বারংবার চেষ্টা করতে পারতেন। নিজেদের মধ্যে সংলাপ করে একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতেন।
নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন মন্তব্য করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, অনেকেই মনে করেন যে নির্বাচন কমিশন এককভাবে একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করে দেবে। আমরা তাদের বলেছি, আমরা বুঝি নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্য অত্যন্ত সীমিত। আমরা নির্বাচনটা আয়োজন করে দেব। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনার যে দায়িত্ব সেটা আমাদেরকে হস্তান্তর করে দিতে হয়। যাদেরকে আমরা হস্তান্তর করব, তাদের ওপর আমাদের নজরদারি থাকবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় নজরদারি থাকতে হবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের রাজনৈতিক দলের। ভোটকেন্দ্রে অতি অবশ্যই পোলিং এজেন্ট দিতে হবে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের প্রধান দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান। বিএনপি সহিংসহ কর্মসূচি পালন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি সহিংসতাপূর্ণ। এটাকে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বলা যেতে পারে না। তারা সন্ত্রাসী দলের মতো কর্মসূচি দিচ্ছে। নির্বাচনের সময় যেকোনো রাজনৈতিক দল যদি অরাজকতা সৃষ্টি করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের প্রতি ব্যবস্থা নিয়েছে এবং নেবে। ইসির আলোচনায় কয়েকটি দল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক খান বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো নির্বাচনে অরাজকতা করে না। যেসব রাজনৈতিক দল নামসর্বস্ব, যাদের ভোটার নেই, তারাই কেবল এ ধরনের কথা বলতে পারে বলে আমরা মনে করি।
আলোচনার পর জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ব্রিফিং করা হয়নি। জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধি প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া জানান, বরাবরের মতো ইসির সব ধরনের প্রস্তুতি জানিয়েছে। আমরা বলেছি, পোলিং, প্রিজাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একটি পক্ষের হয়ে ভোটের দিন কাজ করলে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে জড়িত ১৩৭ জনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছিলাম আমরা। তবে কমিশন এ নিয়ে কোনো কিছু জানায়নি। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে নির্বাহী বিভাগের লোকবল যাতে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করে এবং কেউ পক্ষপাত করলে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা না করতে ইসিকে অনুরোধ জানান জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মোমিনুল আলম। তিনি বলেন, বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি রয়েছে তা নির্বাচন আয়োজনের অনুকূল নয়। ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো প্রহসনের নির্বাচন আর দেখতে চায় না। আমরা চাই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন। ২০১৮ সালের মতো সামনের নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ বর্জন করবে। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বর্তমানে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনুষ্ঠানের কোনো পরিবেশ দেশে নেই।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি আইভি আহমেদ বলেন, আগামী নির্বাচন আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে। এ কারণে এ নির্বাচন নিয়ে ইসিরও দায়-দায়িত্ব অন্যান্য নির্বাচন থেকে বেশি। তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য কমিশনকে আরও কাজ করতে হবে।
আলোচনায় কয়েকটি দল নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলিপ বড়ুয়া বলেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয় এবং এই নির্বাচনে যাতে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সেজন্য নির্বাচন কমিশনকে অর্থবহ পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইনসানিয়াত বিপ্লবের মহাসচিব রায়হান রাহবার বলেন, সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই নির্বাচন পরিচালনা করা হোক। সব ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানো হোক। বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান বলেন, আমরা চেয়েছি যেন সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়। এখানে কোনো কোনো দলের অংশগ্রহণ না হলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।
যে ১৮টি দল অংশ নেয়নি : বিএনপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-(এলডিপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-(বিএমএল), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, খেলাফত মজলিশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণতন্ত্রী পার্টি ও বাংলদেশ মুসলিম লীগ।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More