স্টাফ রিপোর্টার: টানা তাপপ্রবাহে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের জনজীবন। তীব্র গরমে রোজাদারদের অবস্থাও ওষ্ঠাগত। আবহাওয়া অফিস বলছে সহজে দেখা মিলছে না বৃষ্টির। সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে তীব্র রোদ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এ রোদ যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ঝরছে। বিশেষ করে দুপুরের পর আগুন ঝরা রোদের তেজে বাইরে বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা বিরাজ করছে সূর্য একেবারে পাটে পড়ার আগ পর্যন্ত। চলমান তাপপ্রবাহে সবচেয়ে কষ্টে পড়েছে খেটে খাওয়া দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালক ও কৃষকেরা। তীব্র রোদে মাঠে টিকতে পারছেন না কৃষক ও দিনমজুর। আর রিকশাভ্যান চালকরা রাস্তায় রোদে পুড়ছে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত গরম কোনোভাবেই কমবে না।
কৃষকদের প্রতিদিন সেচ দিতে হচ্ছে বোরো ধান ও সবজি ক্ষেতে। কৃষক আরিফুল বলেন, ধানে সেচ দিয়ে আর পারছি না। দাম বেশি ডিজেলের। কিনতে গিয়ে আর পেরে উঠছি না। আল্লাহ একটু পানি (বৃষ্টি) দিলে বাঁচতাম। দিনমজুর আমিরুল মিন্টু বলেন, এতো রোদ মাঠে কাজ করা যাচ্ছে না। একটু কাজ করছি আবার ছায়ায় এসে বসছি। ভ্যানচালক ছাদেক আলী বলেন, রোদে সব পুড়ে যাচ্ছে। দুপুর বেলা মনে হচ্ছে আগুন বের হচ্ছে। রাস্তায় বের হওয়া যাচ্ছে না। গতকাল মঙ্গলবার চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছে। এটি দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগে গত সোমবার ছিলো ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া গত সাতদিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড হয়েছে। আপাতত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা না থাকায় তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের রেকর্ড অনুযায়ী, গত সোমবার জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি, রোববার ৩৯ ডিগ্রি, শনিবার ছিলো ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলয়িাস ছিলো। শুক্রবার ৩৮ ডিগ্রি, বৃহ¯পতিবার ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি, বুধবার ৩৭ ডিগ্রি, মঙ্গলবার ৩৭ ডিগ্রি, সোমবার ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি ও রোববার ৩৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিলো।
চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ইনচার্জ জামিনুর রহমান বলেন, প্রতিদিনই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড হচ্ছে। গত ১০দিন ধরে জেলায় সর্Ÿোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। দু’তিন দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ফলে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে।
এদিকে তাপদাহের কারণে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বেলা বেড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের প্রখরতা আরও বাড়ছে। সড়কে চলাচল করলে শরীরের চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। রোজাদাররা চরম কষ্টে রয়েছে গরমের কারণে।
এ ছাড়া ডায়রিয়া ও টাইফয়েড রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে গরমের কারণে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে শয্যার তুলনায় বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। শিশুরা গরমে বেশি ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালের বহির্বিভাগেও নতুন রোগী বাড়ছে।
দামুড়হুদা জয়রামপুর গ্রামের কৃষক মেহের আলী বলেন, অতিরিক্ত রোদের কারণে মাঠের জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। সেচ দিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। রোদের মাঝেও কষ্ট করে ধানের জমিতে কাজ করতে হচ্ছে। কোনো উপায় নেই।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আসাদুর রহমান মালিক খোকন বলেন, গরম না কমা পর্যন্ত রোগী বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া বাড়তি রোগীর চাপ সামাল দিতে হচ্ছে। শিশু ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গরমজনিত কারণে প্রতিদিন নতুন রোগী আসছেন।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, গেলো কয়েক দিনে তাপপ্রবাহে পুড়ছে দক্ষিণ পশ্চিমের জেলা মেহেরপুর। জেলায় তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৩৯ ডিগ্রিতে ওঠানামা করছে। প্রচ- গরমে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না কেউ। এমন অবস্থায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। কারণ প্রতিদিনের আয়-রোজগারে তাদের ভাটা পড়েছে। আবার তাপপ্রবাহে অনেকেই কাজ করতে পারছেন না। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। তাপপ্রবাহের পাশাপাশি পবিত্র রমজান মাস হওয়ায় গরমে ভোগান্তি কয়েক গুণ বেড়েছে। প্রতিদিন কাজ করতে না পারলে পরিবার পরিজন নিয়ে কীভাবে ঈদ উদযাপন করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় শ্রমজীবী মানুষ।
সরেজমিনে মেহেরপুর শহরের বিভিন্ন সড়কে দেখা গেছে, অনেকেই তীব্র তাপপ্রবাহে কাজের ফাঁকে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে আবার কেউ পানি পান করে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন।
মেহেরপুর সদর উপজেলার কোর্ট মোড়ের মুদি ব্যবসায়ী মামুন বলেন, প্রচ- তাপের কারণে দোকানে একেবারেই বিক্রি নেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতাও কমতে থাকে। দিনমজুর জাব্বারুল বলেন, সকালের দিকে একটু ঠা-া অনুভূত হলেও বেলা যত বাড়ছে সূর্যের তাপও ততই বাড়ছে। রোজা রেখে কাজ করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বারবার চোখে মুখে পানি দিচ্ছি আর কাজ করছি।
চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ জামিনুর রহমান জানিয়েছেন, এ তাপপ্রবাহ আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে। আপাতত দু একদিনের মধ্যে বৃষ্টি বা কালবৈশাখী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এদিকে প্রচ- গরম ও তীব্র তাপদাহে মেহেরপুর শহর, গাংনী উপজেলা সদর ও মুজিবনগর উপজেলা সদর বিভিন্ন স্থানে ও হাট-বাজারে আখের রস, বেল, তরমুজসহ অন্যান্য শরবত জাতীয় পানীয়র বিক্রি বেড়েছে।
জানা গেছে, গত ১০দিন ধরে এ জেলায় তাবদাহের দাপট দিন দিন বাড়ছে। সকাল থেকেই সূর্যের প্রচ- তাপে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে রুক্ষ। সেই সঙ্গে রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরম। সূর্যের প্রখর তাপে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রাণষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ঘর থেকে বের হলেই গরম বাতাস লাগছে আগুনের হলকার মতো। অনেকে সামান্য স্বস্তির জন্য ছুটে চলেছেন গাছের ছায়া তলে। গরমে হাঁসফাঁস করছে প্রাণিকূলও। তাপদাহের কারণে বিপাকে পড়ছেন রোজাদারসহ নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া লোকজন।
আব্দুর রহিম ও জালাল উদ্দীন গাংনী বাজারে এসেছিলেন বেল ও আখের রস কিনতে। দুজনেই জানান, প্রচ- গরমের কারণে এখন বেলের দামও বেড়ে আকাশচুম্বি হয়েছে। ছোট ছোট বেল পাওয়া যাচ্ছে ৩০ টাকা, মাঝারি বেল ৫০ থেকে ৬০ টাকা এবং বড় সাইজের বেল কিনতে হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। তারপরও ঠিকমত পাওয়া যাচ্ছে না।
মেহেরপুর জেলা শহরের বড় বাজার এলাকায় ডাব কিনতে আসা তাইজেল হোসেন জানান, এই তীব্র গরমে ইফতারের সময় একটু আখের রস খেতে পারলে ভালো লাগে। আখের রস আগে এক প্লাস ১০ টাকা ছিলো, কিন্তু এখন সেটা বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে। এছাড়া একটা ডাব বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত।
গাংনী হাসপাতাল বাজার এলাকার ডাব বিক্রেতা শিশিরপাড়া এলাকার আমিরুল ইসলাম ও রুহুল আমিন বলেন, একটা ছোট সাইজের ডাব ৮০ থেকে ৯০ টাকা এবং বড় সাইজের একটা ডাব ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করছি। এই প্রচ- গরমে ডাবের চাহিদা বাড়ায় আমরা বেশি দাম দিয়ে গাছ মালিকদের কাছ থেকে কিনে আনছি। তাই ডাবের দাম অন্যান্য সময়ের চেয়ে এখন কিছুটা বেশি।
ফল ব্যবসায়ী শামীম জানান, এই সময়ে আনারসের চাহিদা বাড়ছে। প্রচ- গরমে মানুষ যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন আনারস খেয়ে তা দূর করেন।
আখের রস বিক্রেতা জাহারুল ইসলাম বলেন, বছর জুড়ে আখেররস বিক্রি হলেও রোজা আসার পর তাপমাত্রা বাড়ায় এর চাহিদা অনেকটাই বেড়েছে। প্রতিদিন ৪/৫ হাজার টাকার রস বিক্রি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এমনিতেই পাড়া মহল্লায় আখের রসের ভালো চাহিদা রয়েছে। তার ওপর রোজা আসায় বিক্রি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। প্রতি গ্লাস আখের রস ৩০ টাকায় বিক্রি করছি। আর এক লিটার রস বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। দৈনিক ২ হাজার টাকার আখেররস বিক্রি করছি।
শরবত বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, রোজার শুরুতে স্বাভাবিকভাবে অন্য সময়ের মতো বিক্রি হয় না। ইফতারির সময় সারাদিনের বিক্রি একবারে হয়ে যায়। তারপরও তাপমাত্রা বাড়ায় বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে।