তিন ফসলী জমি অধিগ্রহণ করার প্রতিবাদে কৃষকদের মানববন্ধন
চুয়াডাঙ্গায় বিজিবির ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজ নির্মাণের প্রস্তুতি
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিজিবির ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করার সকল প্রক্রিয়া সরকার ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে। যেটা মন্ত্রীসভার বৈঠকে আলোচনা শেষে একনেকে অনুমোদন পেয়েছে। সর্বশেষ বিজিবির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ তথ্য জানিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অধিগ্রহণে প্রায় সবাই জমি দিতে রাজি থাকলেও কিছু ভূমি মালিক তাদের জমি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মানববন্ধন করেছেন। গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে চুয়াডাঙ্গা জাফরপুরস্থ ৬ বিজিবি ক্যাম্পের পেছনে হায়দারপুর ও জাফরপুর গ্রামের মাঠে নিজেদের জমির সামনে দাঁড়িয়ে জমিমালিক কৃষকেরা এ মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে তারা বলেন, ‘৩৮ ও ৩৯ নম্বর মৌজায় বিজিবি ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প রয়েছে। সেখানে ট্রেনিং সেন্টার করার জন্য বসত-বাড়িসহ প্রায় ৩শ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হবে শোনা যাচ্ছে। আমরা আমাদের কৃষি জমি হারাতে চাই না। আমরা কোনো মূল্যেই আমাদের কৃষি জমি দিতে চাই না।’ এসময় জমি মালিক কৃষকদের বিক্ষোভ মিছিলও করতে দেখা যায়।
মানববন্ধনে কৃষক রজব আলী, রবিউল ম-ল, সোহেল ম-ল, হামিদুল ম-ল ও মাজেদ আলী বলেন, ‘বিজিবি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার জন্য জাফরপুর মৌজায় ২৭৫ বিঘা ও হায়দারপুর মৌজায় ৭৫ বিঘা কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে আগেই। জেলা স্টেডিয়ামে নির্মাণের জন্য জাফরপুর মৌজায় ৫০ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। জেলা যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাফরপুর মৌজায় ১৫ বিঘা কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পাওয়ার গ্রিড সাব-স্টেশন প্রতিষ্ঠার জন্য জাফরপুর মৌজায় ২০ বিঘা কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সামাজিক বন বিভাগ অফিস ও নার্সারি প্রতিষ্ঠার জন্য জাফরপুর মৌজায় ১৫ বিঘা কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ব্রাক ও গণসাহায্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জাফরপুর মৌজায় ৫ বিঘা কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা। সিএস, এসএ, আরএস রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও জাফরপুর ও হায়দারপুর গ্রামবাসীর ব্যক্তি মালিকানা জমির ওপর খাল খননের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রায় ৩৫০ বিঘা ফসলি জমিতে খাল খনন করা হয়েছে। ট্রেনিং সেন্টার খোলার নামে বর্তমানে বিজিবি বসত-বাড়িসহ প্রায় ৩শ বিঘা কৃষি জমি অধিগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, যা বাস্তবায়ন হলে জাফরপুর ও হায়দারপুর গ্রামে কৃষি জমি বলে কিছুই থাকবে না। আমরা গ্রামবাসী কোনোভাবেই কৃষি জমি আর দিবো না।’
এদিকে জমি মালিক অ্যাডভোকেট আকসিজুল ইসলাম রতন বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় বিজিবির ট্রেনিং সেন্টার হবে, এই জন্য আমারও তিন বিঘার অধিক জমি অধিগ্রহণ করছে। চুয়াডাঙ্গার উন্নয়নের স্বার্থে আমি স্বাচ্ছ্যন্দেই জমি প্রদানসহ সার্বিক সহযোগিতা করবো।’
এছাড়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন জমি মালিক জানান, ‘চুয়াডাঙ্গায় বিজিবির ট্রেনিং সেন্টারের জন্য আমাদের জমিও অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। আমাদের এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে আমরা সরকারকে এই জমি দিচ্ছি।’
চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল খালেকুজ্জামান পিএসসি বলেন, ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিজিবির ট্রেনিং সেন্টার হবে চুয়াডাঙ্গায়। যেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অলরেডি অনুমোদনও দিয়েছেন। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। আর এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করবে জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা। বিধি অনুযায়ী সরকার বাজারমূল্যের চেয়ে তিনগুণ দামে এই জমি অধিগ্রহণ করবে। অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকদের পরিবারের সদস্যদের যোগ্যতা অনুসারে চাকরি, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ যে যে কাজে তাদের সহায়তা করা সম্ভব, আমরা তার সবটাই করতে সচেষ্ট রয়েছি। এছাড়া এখানে ট্রেনিং সেন্টার হলে এই এলাকার উন্নয়ন চিত্র পাল্টে যাবে। নিঃসন্দেহে এটা চুয়াডাঙ্গাবাসীর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে।’
জমি অধিগ্রহণে অসম্মতি জানিয়ে কিছু ভূমি মালিকের আপত্তি ও মানববন্ধন প্রসঙ্গে ৬ বিজিবির অধিনায়ক বলেন, ‘নিজেদের জমিতে প্রত্যোকেরই আবেগ থাকাটাই স্বাভাবিক। তারপরেও আমাদের প্রত্যাশা ও অনুরোধ থাকবে চুয়াডাঙ্গা ও বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থে এই ভূমি মালিকেরা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসবেন। এবং জমি অধিগ্রহণ কাজে সহযোগিতা করে চলমান উন্নয়নে অংশীদার হবেন।’
এবিষয়ে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি সরদার আল আমিনের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিজিবির ট্রেনিং সেন্টার হবে, নিঃসন্দেহে এটা ভালো খবর। এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে আমাদের এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বাড়বে। তবে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জমির মালিকেরা যেনো সরকারি বিধি অনুযায়ী প্রকৃত মূল্য পান, একইসাথে কৃষি জমিও যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর রাখা উচিত। তারপরও সবারই এ জেলার সামগ্রিক উন্নয়ন বিবেচনায় নেয়া উচতি।’
এবিষয়ে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি, চুয়াডাঙ্গা জেলা ইউনিটের সভাপতি নাজমুল হক স্বপনের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিজিবির ট্রেনিং সেন্টার হবে। যেখানে ৩ হাজারের মতো বিজিবি সদস্য নিয়মিত ট্রেনিং করবেন। আমাদের এলাকায় এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে, সেটা আমাদের জন্য ভালোই হবে। এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। এতে করে ওই এলাকাসহ আশপাশের এলাকারও অর্থনৈতিক চিত্র যেমন বদলে যাবে, ঠিক তেমনি চুয়াডাঙ্গা জেলারও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং জমির মালিকদের উচিৎ হবে সামগ্রিক উন্নয়ন বিবেচনায় জমি অধিগ্রহণে সরকারকে সহায়তা করা।’
উল্লেখ্য, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার জাফরপুর ও হায়দারপুর গ্রামের মাঝখানে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ রোডে চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর অবিস্থত। ওখানে বিজিবির ট্রেনিং সেন্টার করার জন্য জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে কৃষকদের দাবি, জাফরপুর ও হায়দারপুরের ৩৮ ও ৩৯ নম্বর মৌজার যে জমি অধিগ্রহণের জন্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, তা তিন ফসলি জমি। এ সকল জমিতে ১৪ মাসে ৪টি ফসল হয় বলেও দাবি কৃষকদের।