ডাকাতদলের মূল নিশানা ছিলো সুপার ব্রিকসের মালিক : যেতে দেরি করায় ঘটে গণডাকাতি
চুয়াডাঙ্গার গহেরপুর-সড়াবাড়িয়া সড়কে গণডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতার ১৩ : একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী
তিনদিন আগে পরিকল্পনা করেন সুজাত : তথ্য দেন ইটভাটার সাইড ম্যানেজারের ছেলে আজিজুল
দর্শনা অফিস: চুয়াডাঙ্গার গহেরপুর-সাড়াবাড়িয়া সড়কে গণডাকাতির ঘটনার তিনদিন আগে করা হয় পরিকল্পনা। পরিকল্পনা অনুযায়ী মূল নিশানা ছিলো সড়াবাড়িয়া সুপার ব্রিকসের মালিক আব্দুল ওয়াহেদ। তিনি ঘটনার দিন ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। তার মধ্যে সরোজগঞ্জ বাজারের জনৈক ব্যবসায়ীকে ১ লাখ টাকা দিয়ে ৯ লাখ টাকা নিয়ে নিজ প্রাইভেটকারযোগে বাড়ি ফিরছিলেন ওয়াহেদ। ওই টাকা ছিনিয়ে নিতেই সড়কে গাছ ফেলে ডাকাতদল। তবে ওয়াহেদের যেতে কিছুটা দেরি হওয়ার সুযোগে ঘটে গণডাকাতির ঘটনা।
চুয়াডাঙ্গার গহেরপুর-সাড়াবাড়িয়া সড়কে গণডাকাতির ঘটনায় ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। ডাকাতির ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেও অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারের স্বার্থে তা গোপন রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ এএইচএম লুৎফুল কবীর।
তিনি বলেছেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন সড়াবাড়িয়া সুপার ব্রিকসের সাইড ম্যানেজার লিটনের ছেলে আজিজুল। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী গণডাকাতির মূল পরিকল্পনা হয়েছিলো ঘটনার ৩ দিন আগে। পরিকল্পনাকারী ছিলেন সুজাত হোসেন। এছাড়া সার্বক্ষণিক তথ্য সরবরাহ করেছিলেন সড়াবাড়িয়া সুপার ব্রিকসের সাইড ম্যানেজার লিটনের ছেলে আজিজুল।
জানা গেছে, গত ৩০ জুন রাত ৯টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গহেরপুর-সাড়াবাড়িয়া সড়কের শালিকচরা নামকস্থানে এ গণডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতির পর গত ২৬ দিনে পুলিশের অব্যাহত অভিযানে ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গত ২ জুলাই রাতে পুলিশি অভিযানে গ্রেফতার হয় গবরগাড়া গ্রামের কদম আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম (৪৫), গহেরপুরের শামসুদ্দিনের ছেলে বদর উদ্দিন (৫০), বাটিকাডাঙ্গার আমিনুল ম-লের ছেলে বিল্লাল ম-ল (২৭), গিরীশনগরের কাদের আলীর ছেলে আবুল কাশেম (৪০)। গত ৪ জুলাই গ্রেফতার করা হয় আন্দলবাড়িয়ার সেলিম হোসেনের ছেলে নাঈম হোসেন (২৫), একই গ্রামের শামসুল শেখের ছেলে সুজাত হোসেন (৩৫), জীবননগরের শাপলাকলিপাড়ার মঈনুল হোসেনের ছেলে রিয়াজ হোসেন (২৪), সাড়াবাড়িয়ার আক্কাস আলীর ছেলে নাজমুল (৩০)। ৫ জুলাই আন্দুলবাড়িয়ার লিটন হোসেনের ছেলে আজিজুল ইসলাম (২০), একই গ্রামের সাহাদ আলীর ছেলে নিশান আলীকে (২৫) গ্রেফতার করা হয়। ৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয় জীবননগরের হাবীবপুরের মহিউদ্দিনের ছেলে নাহিদ হাসান (২১), সাখারিয়া গ্রামের আলী আকবরের ছেলে সম্রাট (২০) এবং গোয়ালপাড়ার আশরাফুলের ছেলে সোহাগকে (২৯)। এছাড়া সন্দেহজনকভাবে আরও চারজনকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ডাকাতি ঘটনায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় পরিবারের হেফাজতে ছেড়ে দেয়া হয়। গ্রেফতারকৃত ১৩ জনের মধ্যে ২৪ জুলাই ৫ জনের মহড়ায় বদরউদ্দিনকে শনাক্ত করে ডাকাতির কবলে পড়া ব্যক্তিরা।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আজিজুলকে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করলে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে গণডাকাতির ঘটনার সাথে আজিজুলের সরাসরি সম্পৃক্ত থাকাসহ বহু তথ্য ফাঁস করেছে। যা মামলার তদন্তের স্বার্থে গোপন রাখা হচ্ছে বলেও জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
গত ৩০ জুন রাত ৯টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গহেরপুর-সাড়াবাড়িয়া সড়কের শালিকচরা নামকস্থানে ১৪-১৫ জনের মুখোশধারী সশস্ত্র ডাকাত দল সড়কে গাছ ফেলে গণডাকাতি করে। এসময় সরোজগঞ্জ থেকে নিজগ্রাম সড়াবাড়ীয়া যাওয়ার পথে জামাল উদ্দিনের ছেলে ঠিকাদার ও ইটভাটা মালিক আব্দুল ওয়াহেদ মিয়ার প্রাইভেটকারের গতিরোধ করে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ ৯ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ সময় ডাকাতেরা তাকে মারধরও করে।
জীবননগর থেকে ঝিনাইদহ যাওয়ার পথে ঝিনাইদহ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনোজ কুমার, ঝিনাইদহ চাকলাপাড়ার বিশ্বজিৎ সাহা, একইপাড়ার স্যানেটারি ব্যবসায়ী রণি সাহা, এএমএম এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদার রাজু আহম্মেদ ও মিলনের কাছ থেকে নগদ ৫২ হাজার টাকা, একটি সোনার চেন, লকেট, ১টি বেসলেট ও ৫টি আংটিসহ ১২ ভরি স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়। যার আনুমানিক মূল্য ধরা হয়েছে ৭ লাখ টাকা।
গড়াইটুপি ইউনিয়নের সুজায়েতপুর গ্রামের রুস্তমের ছেলে বিশারত ও তার ভাইপো মন্টুর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা, পল্লী চিকিৎসক মিলনের মোটরসাইকেল থামিয়ে ২ হাজার টাকা, তেঘরী গ্রামের তৈমুর ও গড়াইটুপি গ্রামের মঙ্গল মাস্টারের ছেলে খোকনের কাছ থেকে ৩ হাজার ২শ টাকা ছিনিয়ে নেয়। ঘন্টাব্যাপি ডাকাতিকালে আলমডাঙ্গা মুন্সিগঞ্জ জেহালা গ্রামের গরু ব্যবসায়ী এলাহি বক্স মধুর ছেলে কুতুব উদ্দিন ও জোড়গাছা গ্রামের শেখ সহিদুল হকের ছেলে আজাদ হোসেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয় ১৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এ ঘটনায় ঝিনাইদহ উপশহরপাড়ার মুরারি মোহন সাহার ছেলে নীল সাহা ওরফে রণি সাহা বাদি হয়ে দর্শনা থানায় মামলা দায়ের করেন। এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন দর্শনা থানার ওসি এএইচএম লুৎফুল কবীর।
গণডাকাতি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ এএইচএম লুৎফুল কবীর জানান, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গণডাকাতির মূল পরিকল্পনা হয়েছিলো ঘটনার ৩ দিন আগে। পরিকল্পনাকারী ছিলেন সুজাত হোসেন এবং সর্বক্ষণিক তথ্য সরবরাহ করেছিলেন সড়াবাড়িয়া সুপার ব্রিকসের সাইড ম্যানেজার লিটনের ছেলে আজিজুল। ঘটনার দিন সুপার ব্রিকসের মালিক আব্দুল ওয়াহেদ চুয়াডাঙ্গার একটি ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। সে টাকার মধ্যে সরোজগঞ্জ বাজারের জনৈক ব্যবসায়ীকে ১ লাখ টাকা দিয়ে ৯ লাখ টাকা সাথে নিয়ে নিজ প্রাইভেটকারযোগে রাত ৯ টার দিকে বাড়ি ফিরছিলেন। পরিকল্পনাকারীদের মূল নিশানা ছিলো ওয়াহেদের ৯ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়া। সে উদ্দেশ্যেই সড়কে বাবলাগাছ ফেলে। ওয়াহেদের আসতে দেরি হওয়ার সুযোগে ঘটে গণডাকাতির ঘটনা। এছাড়া এ ডাকাতি ঘটনায় অংশ নেয় দুপক্ষের ডাকাতদলের সদস্যরা। ইতোমধ্যে আমরা সকলের নাম পরিচয় শনাক্ত করেছি। এখন সময়ের অপেক্ষা। প্রত্যেককে গ্রেফতারে জাল বিস্তার করা হয়েছে। অচিরেই এ জালে আটক হবে ডাকাতির ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকেই। এদিকে গণডাকাতির পর থেকেই চরমভাবে যেমন বিরাজ করছে আতঙ্ক, তেমনিভাবে গ্রেফতার আতঙ্কেও অনেকেই ছেড়েছে এলাকা।