আফজালুল হক: চুয়াডাঙ্গার ঠিকানা ব্যবহার করে ই-কমার্স সাইট ‘জিওফি’র চটকদার বিজ্ঞাপনে হাজার হাজার গ্রাহক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অনিবন্ধিত এই প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ‘সিনেমা হলপাড়া, চুয়াডাঙ্গা’ দেয়া থাকলেও তাদের কোনো অফিসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের প্রায় এক কোটিরও বেশি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অপরদিকে হাজারো গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পণ্য দিচ্ছে না জিওফি। আবার রিফান্ডও দিচ্ছে না। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরগুলোতে ফোন করলে কল যায় না। নেই কোনো হেল্প লাইনও। রিফান্ড বা ডেলিভারির বিষয়ে কথা বললেই ফেসবুক থেকে ব্লক করা হয়। কমেন্ট করলেও মুছে দেয়া হয়। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অল্প দামে মোটরসাইকেল বিক্রির জন্য চুয়াডাঙ্গাসহ সারাদেশে পরিচিতি পায় জিওফি। মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য পণ্য ২১-৩৩ দিনে ডেলিভারি দেয়ার কথা থাকলেও ৪৫ দিনেও দেয়নি জিওফি। ইতোমধ্যে চুয়াডাঙ্গা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে তাদের বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে এখনও পণ্য কিংবা টাকা ফেরত পাননি হাজারো গ্রাহক। খোদ প্রশাসনও জানে না এই প্রতিষ্ঠানটির কথা। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা। বিষয়টি জানার পর প্রশাসনও এখন নড়েচড়ে বসেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত মালিকের খোঁজ মিলছে না। তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া নম্বরগুলোতে ফোন দিলে তা বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে গতকাল সোমবার জিওফি তাদের ওয়েবসাইট থেকে ঠিকানা ‘কলেজ পাড়া, চুয়াডাঙ্গা’ লেখাটি মুছে ফেলেন। প্রতিষ্ঠানটি কার এটা একমাত্র প্রশাসনই খুঁজে বের করতে পারবেন বলে ভুক্তভোগীরা জানান। তারা বলেন, যে মোবাইল ব্যাংকিং নগদের এজেন্ট নাম্বারটি দিয়ে রিফান্ড দেয় এবং পণ্যের জন্য রুপালি ব্যাংকের যে একাউন্ট এ টাকা গ্রহণ করে তা খতিয়ে দেখলেই মালিকের খোঁজ পাওয়া যাবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, জিওফি তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক গ্রুপে প্রতিদিনের কার্যক্রম পোস্ট করে থাকে। যে নম্বরটি (০১৯৪০-৩৪২৬৪৭) দিয়ে তারা রিফান্ড করছে সেটি নগদের এজেন্ট নাম্বার। নগদের চুয়াডাঙ্গা কার্যালয় থেকে জানা যায়, এই এজেন্ট নাম্বারটি দিয়ে ই-কমার্স সাইট আদিয়ান মার্ট তারা গ্রাহকের টাকা রিফান্ড দিয়ে থাকে। অথচ ওই নগদ এজেন্টের নাম দেয়া আছে এম আর ট্রেডার্স। সরেজমিনে আদিয়ান মার্টের অফিসের নিচে গিয়ে হুবহু ‘এম আর ট্রেডার্স’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সন্ধান মেলে। দোকানের ওপরে আদিয়ান মার্টের লোগো দেয়া। আদিয়ান মার্টের সব মালামাল এম আর ট্রেডার্স থেকে গ্রাহকদের ডেলিভারি দিতে দেখা যায়। আদিয়ান মার্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জুবায়ের সিদ্দিকী এই এজেন্ট নাম্বারের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, তাদের কোনো নগদের এজেন্ট নাম্বার নেই। এম আর ট্রেডার্সের কথা বললে তিনি বলেন, এই নামে অনেকেরই দোকান বা প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে। জিওফির গ্রাহক চট্টগ্রামের মেহেদি হাসান দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, গত ১৮ আগস্ট ডিসকভার ১১০ সিসির মোটরসাইকেল বাবদ তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে (৪৭০৫২০০০৪৫০, রূপালী ব্যাংক, চুয়াডাঙ্গার মোমিনপুর শাখা) ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা পেমেন্ট করি। ৩৩ দিনের মধ্যে মোটরসাইকেলটি ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিলো। এখনো পায়নি। গত ১ সপ্তাহ ধরে তাদের দেয়া নাম্বারে ফোন দিয়েছি। ফেসবুক পেজে মেসেজ দিয়েছি, ই-মেইল করেছি। কোনো কাজ হয়নি। সর্বশেষ দুদিন আগে আমাকে রিফান্ড (টাকা ফেরত) দেবে বলে জানানো হয়। এরপর আর যোগাযোগ করেনি তারা। তাদের সব নাম্বার বন্ধ।
ঢাকার উত্তরার শাওন ইসলাম বলেন, গত ১৮ আগস্ট ডিসকভার ১১০ সিসির মোটরসাইকেল বাবদ ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধ করি। ৩৩ দিনে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার কথা থাকলেও এখনো পায়নি। রিফান্ডও দিচ্ছে না আবার মোটরসাইকেলও দিচ্ছে না। তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও করতে পারছি না। শেষে চুয়াডাঙ্গা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরেও অভিযোগ দিয়েছি। সিরাজগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ী তাজ আমিন বলেন, চারধাপে মোট ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার মোবাইল ফোন অর্ডার দিয়েছি জিওফিতে। এর মধ্যে স্মার্টফোন ১৩টি এবং ফিচার ফোন ৫০টি। ২১ দিনে ডেলিভারি দেয়ার কথা থাকলেও দেড় মাসেও ফোনগুলো পায়নি। ফোন নাম্বার বন্ধ থাকায় অসংখ্য মেইল এবং মেসেজ দিয়েছে, কোনো রিপ্লাই পাইনি। পরে আমি চুয়াডাঙ্গা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করেছি। এদিকে সর্বশেষ শনিবার (৩ অক্টোবর) জিওফি অফিশিয়াল হেল্প/সাপোর্ট নামে জিওফির অফিশিয়াল ফেসবুক গ্রুপ একটি পোস্টে বলা হয়, গেটওয়ে অনেক অর্ডার আমরা ডেলিভারি করেছি কিন্তু গেটওয়ে থেকে আমরা সময় মত পেমেন্ট পাচ্ছি না। তাই যাদের গেটওয়ে অর্ডার আছে কিন্তু ডেলিভারি হয়নি তারা আমদেরকে ব্যাংক ডিটেইলসসহ মেইল করুন। আমরা লিস্ট গেটওয়েতে পাঠাবো। আপনাদের কাউকে গেটওয়েতে ফোন করার দরকার নেই। যাদের ব্যাংক পেমেন্ট আছে আমরা গেটওয়ে থেকে অর্থ ছাড়ের ওপর ভিত্তি করে ম্যানুয়ালি রিফান্ড করবো। প্রতি সপ্তাহে কী পরিমাণ রিফান্ড হচ্ছে তার যাবতীয় বিস্তারিত আমরা গ্রুপে আপডেট দেবো। জিওফির ওয়েবসাইটে অফিসের ঠিকানা ‘সিনেমা হল পাড়া, চুয়াডাঙ্গা’ থাকলে ওই ঠিকানায় অফিস তো দূরের কথা তাদের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটি কার এটাও কেউ জানেন না। অত্র এলাকার কেউ জিওফির ব্যাপারেও জানেন না। আবার জিওফি তাদের ওয়েবসাইট থেকে ঠিকানা মুছে দেয়ার গ্রাহকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি জিওফি অফিশিয়াল হেল্প/ সাপোর্ট গ্রুপে আব্দুল মোমিন নামে এক যুবক লাইভ করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায় মোমিন পূর্বে ই-কমার্স সাইট আদিয়ান মার্টে চাকরি করতেন। কয়েকদিন আগে চাকরি ছেড়ে দেন।গ্রুপটি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, প্রায় কয়েক হাজার গ্রাহক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এক কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। বিষয়টি জানার পর চুয়াডাঙ্গার প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে।
বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদের চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি মেহেদি হাসান হিমেল মল্লিক দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, প্রতারণার শিকার হওয়া চট্টগ্রামের কয়েকজন আমাকে বিষয়টি জানান। তবে জিওফি নামে কোনো প্রতিষ্ঠান চুয়াডাঙ্গায় আছে তা আমি কখনো শুনিনি। বলা যায় তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন প্রচুর গ্রাহক তাদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে। এদেরকে আইনের আওয়ায় এনে কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর চুয়াডাঙ্গার সহকারী পরিচালক সজল আহম্মেদ দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, চুয়াডাঙ্গাতে জিওফি নামে কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আছে বলে জানা নেই। এটা অনিবন্ধিত। গত তিনদিনে আমার কাছে বেশকিছু গ্রাহক জিওফির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। আমরা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ ডিটেইলস নিয়েছি। ভুক্তভোগীদের তথ্যানুযায়ী জেনেছি জিওফি আদিয়ান মার্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জুবায়ের সিদ্দিকীর ছোট ভাইয়ের। আমি তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে তারা অস্বীকার করেছে। তিনি আরও বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে আমি জেলা প্রশাসক স্যারের সাথে কথা বলবো। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের নাম আগে কখনো শুনিনি। আমাদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। আর এভাবে সময় মতো পণ্য বা টাকা ব্যাক না দেয়া হতাশাজনক। ঘটনার সত্যতা পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।