বাস বন্ধ থাকায় ইজিবাইক-অটোরিকশায় বাড়তি ভাড়া : ভোগান্তি
স্টাফ রিপোর্টার: এক লাফে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১৫ টাকা। এ জন্য শিগগিরই পরিবহণ ভাড়া ৫০ শতাংশ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন বাস-ট্রাকসহ সব ধরনের পরিবহণ মালিক। ভাড়া বাড়ানোর নানা কারণ দেখিয়ে গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরসহ সারাদেশে যাত্রী ও পণ্যবাহী বাস চলাচল বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করছেন পরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা। তারা জানান, যতোদিন ভাড়া সমন্বয় করা না হবে ততোদিন গাড়ির চাকা ঘুরবে না। তারা জানান, ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। একইসঙ্গে চাকাসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। ২০১৯ সালে বাস ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলেও প্রজ্ঞাপন জারি করে তা কার্যকর করা হয়নি। ফলে বাস ভাড়া ৫০ শতাংশ বাড়ানো উচিত।
অন্যদিকে পণ্য পরিবহণের জন্য ট্রাক-কাভার্ডভ্যান চলাচল বন্ধ থাকায় নিত্যপণ্যের বাজারে ঘাটতি দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে শাকসবজি, আলু, আদা, পেঁয়াজসহ নানা পণ্যের দাম বাড়তির দিকে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) ভাড়া সমন্বয় করে চিঠি পাঠিয়েছে পরিবহণ মালিক সমিতির নেতারা। বিআরটিএ’র ভাড়া পুনর্নিধারণ কমিটি এ উপলক্ষে আগামীকাল রোববার বৈঠক ডেকেছে। জানা গেছে, বিআরটিএ চেয়ারম্যান ওই চিঠি পেয়েছেন। তিনি জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাইছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে সড়ক পরিবহণ ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সারাদেশের সঙ্গে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় দূরপাল্লার পরিবহণ চলেনি কোথাও। আর এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন ৭ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে পরীক্ষার্থীদের। বিভিন্ন জেলার বাস টার্মিনালে গিয়ে তারা দেখতে পান সব ধরনের রুটের বাস চলাচল বন্ধ। এ অবস্থায় অনেকেই আবার পরীক্ষা দিতে পারেননি বলেও জানা গেছে। অনেকে আবার ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন বাহনে করে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হন। এ সুযোগে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন রিকশা, অটোরিকশা আর ভাড়ার মোটরসাইকেল চালকরা। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বিবেচনায় ধর্মঘট প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আগামীকাল মন্ত্রণালয়ে পরিবহন ভাড়া সমন্বয়সংক্রান্ত একটি সভা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ঘটনায় ভাড়া সমন্বয়ের দাবিতে সারা দেশের মতো চুয়াডাঙ্গাতেও অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। তবে রাস্তায় চলছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ পণ্যবাহী বিভিন্ন পরিবহন। শুক্রবার সকাল থেকেই জেলার সবকটি রুটে বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরিণ বাস চলাচল। গন্তব্যে পৌঁছাতে বিকল্প পরিবহন হিসেবে চলছে ইজিবাইক, অটোরিকশা, পাখিভ্যান। যাত্রীদের অভিযোগ, গন্তব্যে পৌঁছাতে বাসের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে এসব যানবাহনে। জরুরি কাজে আলমডাঙ্গায় যেতে হবে ব্যবসায়ী মিনাজ উদ্দিনকে। উপায় না পেয়ে বাসের থেকেও বেশি ভাড়া দিয়ে ইজিবাইকেই যেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে বাস বন্ধ। আলমডাঙ্গায় যেতে বাস ভাড়া লাগে ২৫ টাকা লাগে। কিন্তু ইজিবাইকে ভাড়া চাচ্ছে ১০০ টাকা। এখন ভাড়া বেশি লাগলেও যেতে হচ্ছে।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আবির হোসেন। হঠাৎ বাস বন্ধের সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন তিনি। আবির বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হয়েছে। আমি জরুরি কাজে বাড়ি এসেছিলাম। কিন্তু আগামীকাল (শনিবার) আমাকে ক্লাসে উপস্থিত হতে হবে। চট্টগ্রামে বাস ছাড়া অন্য পরিবহনে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।’ দামুড়হুদা উপজেলার গোপালপুর গ্রামের আব্দুর রহিম তার মা আমেনা খাতুনকে নিয়ে কুষ্টিয়ায় যাবেন চিকিৎসকের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম না বাস ধর্মঘট শুরু হয়েছে। সকাল থেকেই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। বিকল্প কোনো পরিবহনই পাচ্ছিনা। ইজিবাইকে অনেক বেশি ভাড়া চায়।’ জেলা বাস-মিনিবাস মালিক গ্রুপের সভাপতি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, ‘আসলে তেলের দাম বাড়ায় কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলার সবকটি রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তেলের দাম বাড়ালে তো পরিবহনের ভাড়াও বাড়াতে হবে। হয় তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে অথবা পরিবহনের ভাড়া বাড়াতে হবে। অন্যথায় অনির্দিষ্টকালের বাস ধর্মঘট চলবে।’
জেলা সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাবিবুর রহমান লাভলু জানান, ‘মূলত চুয়াডাঙ্গা জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বাস চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে চলাচল করছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ পণ্যবাহী পরিবহন। এগুলোর বিষয়ে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত আসেনি। আগামীকাল (শনিবার) সিদ্ধান্ত হতে পারে।’
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, সারাদেশের মতো মেহেরপুরেও শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে বন্ধ রয়েছে আন্তজেলা ও দূরপাল্লার বাস। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন এ জেলার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সৌদি আরবের প্রবাসী শ্রমিক সোহাগ আলী ১০ বছর পর ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। ছুটি শেষে তার কাজে ফেরার সময় চলে এসেছে। তবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে ভাড়া সমন্বয়ের দাবিতে ডাকা বাস ও ট্রাক ধর্মঘট ফেরার বিষয়টি অনিশ্চিত করে তুলেছে। সোহাগ আলীর বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বামন্দী গ্রামে। তিনি ১০ বছর ধরে সৌদি আরবে কাজ করেন। প্রথম সাত বছর তার কাজের অনুমতি ছিলো না। পরের তিন বছর বৈধভাবে কাজ করার পর ছুটিতে বাড়ি আসেন। সোহাগ বলেন, ‘৭ নভেম্বর আমার ফ্লাইট। তার ২৪ ঘণ্টা আগে করোনা টেস্টের রিপোর্ট লাগবে। আমাদের জেলায় আরটিপিসিআর ল্যাব নেই। এয়ারপোর্টে নানা জটিলতা। সে কারণে এই জেলার সবাই কুষ্টিয়ায় টেস্ট করাব। ‘সকালে শুনলাম কোনো বাস চলবে না। আমি এখন মহাবিপদে। কুষ্টিয়া পর্যন্ত যেতে পারব। তবে মাইক্রোবাসে ঢাকা যাওয়ার সামর্থ্য তো আমার নাই। এমনিতেই ধারদেনা করে ফিরছি। এখন যদি আমার যাওয়াই বন্ধ হয়ে তখন কী করব? বিদেশ যেতে না পারলে আমার মরা ছাড়া কোনো গতি থাকবে না।’ সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, বুধবার রাত ১২টা থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে বেড়ে গেছে ১৫ টাকা। এতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরিমালিকরা শুক্রবার ভোর থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধের ঘোষণা দেয়। এরপর পরিবহন মালিক সমিতিও শুক্রবার থেকে বাস চালানো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা দেশে মতো ঝিনাইদহের বিভিন্ন রুটে শুক্রবার সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু হয়েছে। ফলে সকাল থেকে ঝিনাইদহের সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ বিভিন্ন মালামাল ও যাত্রী পরিবহন বন্ধ রয়েছে। যানবাহন বন্ধ থাকায় দূরপাল্লার যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন। জ্বালানি তেলের বর্ধিত এ দাম না কমানো পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে বলেও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। শুক্রবার সকালে শহরের বাসটার্মিনাল, আরাপপুর, বাইপাস সড়ক, চুয়াডাঙ্গা স্ট্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে, ছেড়ে যায়নি দুরপাল্লা ও স্থানীয় রুটের কোন জ্বালানী তেলবাহী যানবাহন। এমনকি পরিবহনের টিকিট কাউন্টারগুলো বন্ধ। এদিকে শহরের বিভিন্ন বাস স্টান্ডে সকাল থেকেই ভীড় দেখা গেছে ঢাকা, কুষ্টিয়া, খুলনা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন গন্তব্যগামী যাত্রীদের। অনেককে দেখা গেছে পায়ে হেটে কিংবা ব্যাটারি চালিক ইজি বাইকে করে গন্তব্যে যেতে। রুহিনী কুমার রায় নামে এক যাত্রী জানান, চিকিৎসার জন্য এক আত্মীয়কে নিয়ে তিনি যশোর যাবেন। কিন্তু এসে শুনতে পান বাস ধর্মঘটের কথা। এখন কোথায় যাবেন, কী করবেন কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না তিনি। শুক্রবার দুপুরে ঝিনাইদহ বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন সাফিয়া বেগম। তিনি বলেন, অসুস্থ ভাইকে দেখতে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছি। স্ট্যান্ডে এসে শুনি বাস চলাচল বন্ধ। এখন ব্যাগ আর দুই বাচ্চাকে নিয়ে বিপদে পড়েছি। পুরান ঢাকার বাসিন্দা মারুফ হোসেন জানান, ঝিনাইদহে আতœীয় বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। এখন ঢাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য বাস টার্মিনালে এসে দেখি যানবাহন চলাচল বন্ধ। এখন কি করে ঢাকায় ফিরবো বুঝতে পারছি না। মিরাজ নামের অপর এক যাত্রী জানান, ঢাকায় একটি স্কুলের ভ্যান চালায়। কালকের মধ্য পৌছাতে হবে। কিন্তু কোন বাহন পাচ্ছি না। ঝিনাইদহ জেলা বাস-মিনিবাস পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি রোকনুজ্জামান রানু জানান, ডিজেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। কিন্তু সরকার এখনও দাম কমানোর বিষয়ে আমাদের সাথে কোন কথা বলেনি। তাই দাম না কমা পর্যন্ত এ ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ