চুয়াডাঙ্গায় মোবাইলফোন কেড়ে নেয়ায় কি পিতাকে খুন : নেপথ্য নিয়ে ধুর্মজাল
ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে বোনের মামলা : আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছেলের
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা শহরের পলাশপাড়ায় নামাজ পড়া অবস্থায় ইতালি ফেরত প্রবাসী ব্যবসায়ী দোদুল হোসেন হত্যাকান্ডের ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে নিহত ব্যক্তির একমাত্র কিশোর ছেলে (১৭)। গতকাল রোববার বিকেলে চুয়াডাঙ্গার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. রিপন হোসেন তার জবানবন্দি নথিভুক্ত করেন। পরে তাকে যশোর পুলেরহাটের শিশু উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেয়া হয়। গত শনিবার দিবাগত রাতে বাড়িতে তারাবি’র নামাজ পড়া অবস্থায় উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে নৃশংসভাবে ওই প্রবাসী ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরপরই সদর থানা-পুলিশ নিহত ব্যক্তির বাড়ির একটি কক্ষের খাটের নিচ থেকে মাদরাসায় পড়া ছেলেকে আটক করে। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকা-ের ঘটনায় নিহত ব্যক্তির মেয়ে বাদী হয়ে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে গতকাল রোববার থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় নিহত ব্যক্তির স্ত্রীকে সাক্ষী করা হয়েছে। এদিকে, দোদুলের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে দুপুরে পৈত্রিকভিটা কুষ্টিয়ার গির্জানাথ মজুমদার সড়কের বাড়িতে নেয়া হয়। বিকেলে সেখানেই দাফন সম্পন্ন করা হয়।
জানা গেছে, কুষ্টিয়া শহরের কমলাপুর গির্জানাথ মজুমদার সড়ক এলাকার মৃত কাজী নূর মোস্তফার ছেলে দোদুল হোসেন ওরফে কেএএম রিন্টু (৫০)। প্রায় ৩০ বছর আগে চুয়াডাঙ্গা শহরের সবুজপাড়ার ব্যাংক কর্মকর্তা কবির হোসেনের মেয়ে আইরিন পারভীন রত্নাকে বিয়ে করেন। বিয়ের কয়েক বছরপরই পাড়ি জামান ইতালি। প্রবাস থেকে স্ত্রী রত্নার নামে টাকা পাঠাতে থাকেন রিন্টু। রত্নার পিতার বাড়ি এলাকা চুয়াডাঙ্গা শহরের পলাশপাড়ায় জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেন এবং চুয়াডাঙ্গাতেই স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। তিন বছর আগে রিন্টু প্রবাস ফিরে জানতে পারেন তার সমস্ত সম্পত্তি স্ত্রী রত্না নিজের নামে কিনেছেন। রিন্টুর নামে কানাকড়িও নেই। এ নিয়েও মাঝে মধ্যে পারিবারিক কলহ লেগেই থাকতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রতিবেশী জানান, ঘটনার দিন রক্ত্যক্ত অবস্থায় ঘরের মেঝেই পড়েছিলেন রিন্টু। রক্ত্যক্ত স্বামীকে ঘরে রেখেই মেইন গেটের কাছে এসে কাকে যেন ফোন করেছিলেন স্ত্রী রত্না। প্রায় ২০/২৫ মিনিট পর ভাড়াটিয়ারা প্রতিবেশীদের ডেকে রিন্টুকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। রিন্টুকে হাসপাতালে নেয়ার প্রায় আধাঘন্টা পর আসেন রত্না। যা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এ প্রতিবেশীদের। প্রতিবেশীরা আরও জানিয়েছে, ঘটনার সময় পরনে থাকা কাপড় পরিবর্তন করে রত্না প্রায় আধা ঘন্টা পর হাসপাতালে আসেন। এ সময় জরুরি বিভাগের সামনেই নিহত রিন্টু বোনের সাথে রত্নার কথা কাটাকাটি হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে। পুলিশ তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত রহস্য। নিহত রিন্টুর শরীরে ৬/৭ বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। কিশোর ছেলের পক্ষে কি একা সম্ভব? প্রশ্ন রেখেছে প্রতিবেশীরা বলেন, রত্না পরকীয়ায় আসক্ত। স্বামী দেশে ফিরে আসায় তাদের পরকীয় সম্পর্কের বাধা সৃষ্টি হয়। এতে পরিবারের সাথে ঝগড়া লেগেই থাকতো। এজন্যই কি ছেলে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলো। দীর্ঘদিন পর পিতা প্রবাস জীবন থেকে বাড়ি ফেরায় তার চলাচলেও গতি পরিবর্তন করতে হয়। বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের হচ্ছে এটা দেখার পরও মা-মেয়ে কেন দোদুলকে হাসপাতালে নেয়নি; এমন কি কাউকে ডাকেওনি। এ নিয়েও দেখা দিয়ে ধুম্রজাল।
এদিকে, নিজ বাবাকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার কিশোরকে রোবাবর বিকেলে চুয়াডাঙ্গার আমলি আদালতে সোপর্দ করে থানা পুলিশ। আদালতের বিচারক জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. রিপন হোসেন তাকে খাস কামরায় নিয়ে ঘটনার পূর্বাপর জানতে চান। তখন আসামি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে চাইলে আদালত তার জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক দেওয়ান তারিকুল ইসলাম বলেন, বাবার হত্যায় অভিযুক্ত কিশোরকে সময় স্বল্পতার কারণে কারাগারের নিরাপদ হেফাজতে রাখা হয়েছে। সোমবার সকালে তাকে যশোর পুলেরহাটে কিশোর উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠানো হবে।
মামলার সংক্ষিপ্ত এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ১১ মার্চ তিনি বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। বিবাদী তার একমাত্র ভাই। সে স্থানীয় একটি মাদরাসার দশম শ্রেণির ছাত্র। কয়েক বছর ধরে সে মোবাইলফোনে বিভিন্ন গেম, ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউবে আসক্ত হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে মাদক সেবনেও আসক্ত হয়। বিষয়টি বাবার দৃষ্টিগোচরে এলে বাবার সঙ্গে তার (বিবাদীর) মনোমালিন্য হয়। বাবার কথা না শুনে সে মোবাইলফোন ও মাদক নিয়ে পড়ে থাকতো। ২২ মার্চ (ঘটনার দিন) সকাল ৯টার দিকে বাবা বিবাদীর কাছ থেকে মোবাইলফোন কেড়ে নেন। এতে বিবাদী ক্ষিপ্ত হয় এবং বাবাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। রাত পৌনে ৮টার দিকে বাবা নামাজ পড়তে থাকলে বিবাদী আগের ঘটনার জেরে ধারালো ছুরি দিয়ে পেছন থেকে পিঠে, কাঁধে, কপালে ও কনুইতে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। বাবার চিৎকারে তিনি ও তার মা বিবাদীর হাত থেকে তাকে উদ্ধার করেন। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় দ্রুত সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে তিনি মারা যান।
আদালতসূত্র জানায়, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ওই কিশোর তার বাবার হত্যাকা-ের কথা স্বীকার করে বলে, প্রবাস থেকে দেশে ফেরার পর বাবা-মায়ের মধ্যে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকতো, যা নিয়ে সে মানসিকভাবে অস্বস্তিতে ছিল। এর মধ্যে শনিবার মোবাইলফোন কেড়ে নেয়ায় সে বাবার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এরপর বাবাকে রাতে শারীরিকভাবে আঘাত করার সিদ্ধান্ত নেয়। আঘাতের আগে সে গাঁজা সেবন করে। কিশোর আদালতকে জানায়, বাবাকে শারীরিকভাবে আঘাতের সিদ্ধান্ত নিলেও তাকে হত্যার কোনো পরিকল্পনা ছিলো না।
একটি সূত্র জানিয়েছে রিন্টুর বোন অথবা ভাই আজকালের মধ্যেই আরও একটি মামলা দায়ের করবেন।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.