সুপার সাইক্লোন আম্পানের তা-বে ভেঙে গেছে চাষিদের স্বপ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: ঘূর্ণিঝড় আম্পান কেড়ে নিয়েছে চুয়াডাঙ্গার চাষিদের স্বপ্ন। ভেঙে দিয়েছে তাদের মেরুদ-। চাষিরা কেউ কাঁদছে জোরে আবার কেউ কাঁদছে নীরবে। তাদের কান্নার হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে বাতাসে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তা-বে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চুয়াডাঙ্গার আমবাগান মালিকরা। পরপর দু’টি ঝড়ে ভয়াবহ সংকটের মুখে আমচাষিদের ধারণা, এ মরসুমে আম বিক্রি করে সারাবছরের বাগান পরিচর্যা ও শ্রমিকের মজুরি উঠে আসবে না। এছাড়া, চলমান লকডাউনের ফলেও আম পরিবহনে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন আমবাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে, সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাতে দামুড়হুদা উপজেলায় কলা, পেঁপে, আম, পানবরজসহ বিভিন্ন সবজি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চাষিদের এ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া খুব কষ্টকর হবে। এলাকার চাষিরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারী চাষিদের মাঝে বিনামূল্যে জরুরিভাবে সার, বীজ ও বিনা সুদে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করলে এ বিশাল ক্ষতির কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন তারা।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত মরসুমে জেলাতে ১ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিলো। চলতি মরসুমে আছে ১ হাজার ৯৮০ হেক্টর। এ হিসেবে এবারে ৩০ হেক্টর জমিতে আমের নতুন বাগান হয়েছে। এসব বাগান থেকে ফলন হবে ২৯ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন আম। পাইকারি ১ হাজার ২০০ টাকা মণ হিসেবে ৮৯ কোটি ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা ছিলো। তবে সাম্প্রতিক ঝড়ে ১০ হাজার ৫৮৪ মেট্টিক টন আমের ক্ষতি হয়েছে। যার মূল্য ৩১ কোটি ৭৫ লাখ ২০ হাজার টাকা।
চুয়াডাঙ্গার আম ব্যবসায়ী সমিতি সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় এবার ফলন ভালো হয়েছে। করোনার কারণে বাজারজাত করা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছি। তবে আমাদের এলাকার হিমসাগর, ল্যাংড়া, বোম্বাই, আ¤্রপালিসহ অনেক ভালো ভালো জাতের আম ফলে। এসব আম খুবই সুস্বাদু, দেশ-বিদেশে এর খ্যাতি আছে। তবে পরপর দুটি ঝড়ে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ মরসুমে আম বিক্রি করে সারা বছরের বাগান পরিচর্যা ও শ্রমিকের মজুরি উঠবে কিনা সংশয়ে আছি।’ আম বর্গাচাষি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় উৎপাদিত আম জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে রফতানি করে থাকি। কিন্তু করোনার কারণে আমাদের এই আমগুলো বাজারজাত করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসকের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।’ আরেক বর্গাচাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েকদিন আগে বয়ে যাওয়া আম্পান ও কাল বৈশাখী ঝড়ে প্রচুর আম ঝরে গেছে। এতে আমরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। অবশিষ্ট যে আমগুলো গাছে আছে, এর সঠিক বাজারজাতকরণ দরকার। এর জন্য সরকারের কাছে দাবি সহযোগিতার জানাচ্ছি।’
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আলী হাসান বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গার হিমসাগর আম বিখ্যাত। আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা যাতে সঠিক দামে আম বিক্রি করতে পারেন সেজন্য জেলা প্রশাসনকে সাথে নিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। এ জেলা থেকে বিভিন্ন মোকামে আম পাঠাতে বা বিক্রি করতে কোনো ধরনের সমস্যা যাতে না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছি।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মোকাম থেকে যেসব ব্যবসায়ী চুয়াডাঙ্গায় আম কিনতে আসবেন তাদের নির্বিঘেœ আসা, থাকা, খাওয়া এবং নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছুর দেখভাল করার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।’ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমসহ সকল প্রান্তিক চাষিকে কৃষি প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসার জন্য সরকার ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে বলেও জানান তিনি। এ জেলার হিমসাগরসহ বিভিন্ন জাতের আমের চাহিদা রয়েছে দেশ-বিদেশে। করোনার কারণে আম বিক্রি নিয়ে চাষিরা দুশ্চিন্তা করলেও ন্যায্যমূল্য ও মোকামে পাঠানোর ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এ দাবিসহ ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের কৃষি প্রণোদনা দেয়ার প্রত্যাশা করছেন এখানকার আমচাষিরা। অপরদিকে, দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানা গেছে, সুপার সাইক্লোন আম্পানে উপজেলায় বিভিন্ন প্রজাতির কলাবাগান, পেঁপে বাগান, সবজিক্ষেত, পানবরজ, বোরো ধান, ও মুগডালসহ বিভিন্ন ফসলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা। দামুড়হুদা দশমী গ্রামের কলাচাষি হাফিজুর রহমান বলেন, গ্রামের মাঠে আমার প্রায় সাড়ে সাত বিঘা পেঁপে বাগান রয়েছে। আম্পানের আঘাতে আমার বাগান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট ধার দেনা করে বাগান করেছি। সরেজমিনে বাগান ল-ভ- হওয়ার কথা বলতে গিয়ে নীরবে কেঁদে ফেলেন তিনি। কোষাঘাটা গ্রামের পানচাষি ছানোয়ার বলেন, গ্রামের মাঠে ১০ কাঠা জমিতে পান বরজ ছিলো। গ্রামের লিয়াকত ও সুমনের মতো আমারও পানবরজ নষ্ট হয়ে গেছে। পানবরজ হারিয়ে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। এ সকল ক্ষতিগ্রস্ত পানবরজের ওপর সুদবিহীন ঋণ দিলে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখবো। জয়রামপুর গ্রামের ছাত্তারসহ একাধিক সবজি চাষি বলেন, লাউ, চিচিঙ্গে ও ঝিঙ্গেসহ নানা ধরনের সবজিক্ষেত প্রচ- ঝড় বৃষ্টির কবলে পড়ে পানিতে তলিয়ে পচে নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকে জমি লিজ নিয়ে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এ আবাদ করেছেন। এ সাইক্লোন চাষিদের মেরুদ- ভেঙে দিয়েছে। দামুড়হুদা বাজারপাড়ার বোরো ধানচাষি শফিকুল বলেন, দামুড়হুদা সোলার বিলে আমার ১ বিঘা ও বজলু নামের অপর চাষির ২ বিঘা জমির ধান কাটতে দেরি হওয়ার কারণে সাইক্লোন ও প্রচ- বৃষ্টির কবলে পড়ে সব ধান পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। আম ব্যবসায়ী আব্দুল গনি ও রফিক বলেন, হাতের সমস্ত পুঁজি মহাজনের দেনা করে আম বাগান কিনেছিলাম। মহাজনের দেনা পরিশোধসহ পুঁজি হারা হয়ে গেলাম। মদনা গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস বলেন, পরের জমি লিজ নিয়ে ও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ করে ৭ বিঘা জমিতে কলা বাগান করেছিলাম। কলা কিছু বিক্রি করার পর সাইক্লোন আমার স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে গেছে। এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারী চাষিদের দাবি, সুপার সাইক্লোন আম্পান ঝড় ও বৃষ্টিপাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে পেঁপে, কলা, পানবরজ, আম ও সবজি রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের মাঝে দ্রুত বিনামূল্যে সার, বীজ ও বিনা সুদে ঋণ বিতরণের জরুরি প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা এ সকল সুবিধা পেলে এই কঠিন সময়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। উপজেলা কৃষি কর্মকতা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, এ জেলায় ১৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড এবং সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮২ কিলোমিটার বেগে সুপার সাইক্লোন আম্পান আঘাত হানে। তাতে দামুড়হুদা উপজেলার কলা, পেঁপে, আম, সবজি, পানবরজ, বোর ধান, মুগডালসহ অন্যান্য সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ ৩২ কোটি ২৮ লাখ ৪ হাজার ৫শ’ টাকা। চাষিদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া খুব কঠিন হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারী চাষিদের মাঝে দ্রুত বিনামূল্যে সার, বীজ ও বিনা সুদে ঋণ বিতরণ প্রয়োজন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম মুনিম লিংকন বলেন, সুপার সাইক্লোন আম্পানে ১০ মেট্রিকটন চাল, ৩৫ বান টিন, নগদ ১ লাখ ৫ হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ পেয়েছি। অধিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সহযোগিতার জন্য চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রকে তালিকা তৈরির জন্য বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে কৃষি বিভাগ উপজেলায় কলা, পেঁপে, আম, পানবরজ, বোরো ধান, মুগডালসহ সবজি কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপন করেছে। তাছাড়া এলাকায় ত্রাণ সহযোগিতা, ১০ টাকায় চাল, টিসিবি পণ্যসহ নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নগদ টাকার মানবিক সহায়তা কর্মসূচির টাকা ছাড়া শুরু হয়েছে।