চুয়াডাঙ্গার তিতুদহে টিসিবি ও ভিজিএফ’র কার্ড ভাগাভাগি নিয়ে দু’পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ

প্রকাশ্য দিবালোকে বিএনপি নেতা রফিককে কুপিয়ে হত্যা : আহত ৪

বেগমপুর প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার তিতুদহে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে রফিকুল ইসলাম রফিক নামের এক বিএনপি নেতা কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। এ সময় নিহত রফিকুলের ভাইসহ আরও ৪ জনকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করা হয়েছে। নিহত রফিকুল ইসলাম (৪৫) তিতুদহ কাউন্সিলপাড়ার রহিম উদ্দিন মল্লিকের ছেলে। রকিফুল ইসলাম রফিক চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। নিহতের পরিবার এ ঘটনায় তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মিলন মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মো. টোটনসহ তার অনুসারীদের দায়ী করেছেন। নিহত রফিকুলের লাশের ময়না তদন্ত শেষে গ্রাম্যকবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করে পরিবারের লোকজন। এঘটনায় পুলিশ ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন আছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। সেই সাথে হত্যার কাজে ব্যবহৃত আলামত হাসুয়া, রড় এবং বাঁশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় এখন অবদি কোন মামলা বা গ্রেফতার হয়নি বলে পুলিশ জানিয়েছে। আহতরা হলেন- তিতুদহ গ্রামের মাঝেরপাড়ার মৃত রহিম মল্লিকের ছেলে এবং নিহত রফিকের বড় ভাই শফিকুল ইসলাম (৫০), একই গ্রামের কামারপাড়ার মৃত জহুরুল ইসলামের ছেলে রফিকুল ইসলাম (৫০), মৃত আবু বক্করের ছেলে আব্দুল আলিম (৫৫) ও একই ইউনিয়নের হুলিয়ামারি গ্রামের মৃত শরবত ম-লের ছেলে আইনাল হক (৫০)। আহতদের উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। আহতদের মধ্যে শফিকুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

নিহত রফিকের ফাইল ছবি

স্থানীয়রা জানান, চুয়াডাঙ্গার তিতুদহ ইউনিয়ন পরিষদের সরকারি সুবিধাভোগীদের তালিকা করা নিয়ে বেশকিছু দিন ধরে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে বিরোধ চলে আসছিলো ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাংগাঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রফিকের সাথে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শনিবার বেলা ১১টার দিকে দু’পক্ষই তিতুদহ ইউনিয়ন পরিষদে যান। সেখানে টিসিবির কার্ড করা নিয়ে পূর্ববিরোধী জের এবং বর্তমানে ভিজিএফর তালিকা করা নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে বাকবিত-া শুরু হয়। একপর্যায়ে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে প্রতিপক্ষ হাসুয়া দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপালে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাংগাঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রফিক। এদিকে সংঘর্ষের পরপরই এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ আতঙ্কে দোকান-পাট বন্ধ করে দেন। এলাকাজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা ফরিদুল ইসলাম শিপলু জানান, আওয়ামী লীগের লোকজন দলে অনুপ্রবেশ করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আমরা প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবো।
নিহত রফিকুলের স্ত্রী নাহিদা খাতুন মুক্তি ও ছেলে রাব্বি হোসাইন অভিযোগ করে বলেন, দলীয় পদপদবীর কারণে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা খেয়াল খুশি মত ভাগবাটোয়া এবং ভোগ করে আসছে তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মিলন মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম টোটন। এতে করে প্রকৃত ব্যক্তিরা বঞ্চিত হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করে আসছে রফিক। তার কারণে পরিকল্পিতভাবে পূর্বপ্রস্তুতি এবং লোকজন নিয়ে এসে মিলন মিয়া, টোটন মিয়া তার ছেলে আকাশ, ভাতিজা ইউনিয়ন যুবলীগের প্রচার সম্পাদক প্যানেল চেয়ারম্যান তছলিমুজ্জামান সাগর, ইউপি সদস্য কামাল, রিপন, মিন্টু, শওকতসহ বড়সলুয়া, গবরগাড়া, গিরিশনগর, নুরুল্লাপুর, বলদিয়া, তিতুদহর লোকজন প্রকাশ্যে দিবালকে কুপিয়ে রফিককে হত্যা করেছে। উদ্দেশ্যে একটাই অন্যায়ের প্রতিবাদকারীকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে হবে। শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে হত্যা করার এ পরিকল্পনা গিরিশনগর বাজারে বসে হয়েছে। আমারা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
তিতুদহ ইউপি প্রশাসক আব্দুল আওয়াল বলেন, শনিবার ভিজিএফ’র তালিকা করার প্রস্তুতি মূলকসভা ছিলো। পরিষদে ঢুকতেই দেখি কিছু লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পরিষদের গেটে অবস্থান করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মারামারি শুরু হয়ে যায়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং জেলা প্রশাসককে অবহিত করে পরিষদ থেকে চলে আসি। ঘটনার পরপরই সেনাবাহিনী, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও দর্শনা থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শানে আসেন। ৫নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য কাছেদ আরী বলেন, ভিজিডি’র কার্ড ভিজিডি’র কার্ড ভাগ করার জন্য পরিষদে যায়। যেয়ে দেখি দু’পক্ষের মারামারি।
চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার খন্দকার গোলাম মওলা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, পুলিশ অফিসাররা ঘটনাস্থলে গিয়েছে। বর্তমানে এলাকার পরিবেশ পরিস্থিতি শান্ত আছে। চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কনক কুমার দাস সাংবাদিকদের বলেন, টিসিবির কার্ড বন্টন নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এরপরই সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই রফিক নামের একজন মারা যায়। কয়েকজন আহত হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গতকাল রাত ১০টার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দর্শনা থানার অফিসার এনচার্জ ওসি শহীদ তিতুমীর বলেন, ভিজিডি’র কার্ড ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপি’র দুপক্ষের মধ্যে আজকের এ ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে মারামারিতে ব্যবহৃত হাসুয়া, রড় এবং বাঁশ উদ্ধার করা হয়েছে।
তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা বলেন, বর্তমানে তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত। তাদের এসব অপমর্কার প্রতিবাদ করে আসছিলো রফিক ও মুকুল। প্রতিবাদ করায় কাল হলো রফিকের।
দর্শনা থানা বিএনপির সভাপতি খাজা আবুল হাসনাত বলেন, তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক স¤পাদক রফিকুল ইসলাম ছিলো প্রতিবাদী। ওই ইউনিয়নের সভাপতি মিলন মিয়া ও সাধারণ স¤পাদক টোটনের বিভিন্ন অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তাকে জীবন দিতে হলো। এছাড়া রফিকের ভাই শফিকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনি আরো জানান, বিএনপি একটা বৃহত্তর দল। এখানে নেতৃত্বের লড়াই থাকবে, মতভেদ থাকবে তাই বলে কাউকে মেরে ফেলতে হবে এটা কোনো ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দল অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির সভাপতি মাহামুদ হাসান খান বাবু নিহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, বিষয়টি তদন্তপূর্বক দোষিদের বিরুদ্ধে আজকালের মধ্যেই সাংগাঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে নিহত রফিকের লাশের ময়না তদন্ত শেষে রাত ৯টার দিকে নামাজে জানাজা শেষে গ্রাম্য কবরস্থানে দাফন কার্য সম্পন্ন করা হয়েছে। জানাজায় অংশগ্রহণ করেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক স¤পাদক খালিদ মাহমুদ মিল্টন, দর্শনা থানা বিএনপির সভাপতি খাজা আবুল হাসনাত, দর্শনা থানা বিএনপির সাংগঠনিক স¤পাদক আবুল মুহিত, জেলা কৃষক দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম বিলু, দর্শনা থানা যুবদলের আহ্বায়ক জালাল উদ্দীন লিটন, যুগ্ম-আহ্বায়ক শরীফুজ্জামান শামিম, যুগ্ম-আহ্বায়ক সরোয়ার হোসেন, দর্শনা পৌর বিএনপি নেতা খেদু, তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি হাজি খলিলুর রহমানসহ বিভিন্ন ওয়ার্ড বিএনপির সুপার ফাইভের নেতা কর্মী ও স্থানীয় অনেক লোকজন। নিহত রফিকুল এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More