কেরুর উৎপাদিত চিনিও পাচ্ছেন না চুয়াডাঙ্গাবাসী
ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বরাদ্দ না থাকায় বাজারে চিনি সরবরাহ বন্ধ
স্টাফ রিপোর্টার: বাজারে চিনির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই সংকটের প্রভাব পড়েছে দেশের অন্যতম চিনিকল কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড যে শহরে অবস্থিত সেই দর্শনা শহরে। আখের সরবরাহ কমে যাওয়ায় সেখানে চিনির উৎপাদন কমে গেছে। এ কারণে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বাজারে গিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলার মানুষ কয়েক মাস ধরে এই চিনিকলের চিনি কিনতে পারছেন না।
চিনিকল সূত্র জানায়, চলতি মরসুমে নির্ধারিত সময়ের আগেই এই চিনিকলে মাড়াই কার্যক্রম শেষ হচ্ছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এবার চিনি আহরণের হার নেমে গেছে ৫ শতাংশের নিচে। ফলে কোনোভাবেই চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত চাহিদা অনুযায়ী আখের জোগান না পাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান ২৩ ডিসেম্বর কেরু চিনিকলে মাড়াই মরসুমের উদ্বোধন করেন। চলতি মাড়াই মরসুমে ৫৩ কার্যদিবসে ৬২ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৮৮৪ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। চিনি আহরণের হার ধরা হয়েছিলো ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ।
কেরুর মহাব্যবস্থাপক (কারখানা) সুমন কুমার সাহা জানান, ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৪ কার্যদিবসে ৩৮ হাজার ৪১০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে এক হাজার ৮৩১ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হয়েছে। চিনি আহরণের হার ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আখের অভাবে ২ ফেব্রুয়ারি মাড়াই মরসুম শেষ হয়ে যেতে পারে। অথচ চাহিদা অনুযায়ী আখ সরবরাহ পাওয়া গেলে ১৪ ফেব্রুয়ারি আখ মাড়াই শেষ হওয়ার কথা।
চিনিকল কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০২০-২১ মাড়াই মরসুমে ৯৪ দিনে ১ লাখ ১১ হাজার ৮৬০ দশমিক ৭৮০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৫ হাজার ৮৮৩ মেট্রিক টন চিনি পাওয়া যায়। ওই মরসুমে চিনি আহরণের হার ছিল ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০২১-২২ মরসুমে আখ মাড়াই অর্ধেকেরও নিচে নেমে যায়। এ মরসুমে ৫৩ হাজার ৬৯২ দশমিক ৮৮৫ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ২৩ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হয়।
চুয়াডাঙ্গা সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আজিজুর রহমান দর্শনা পৌর শহরের বাসিন্দা। বাজারে স্থানীয় চিনিকলের চিনি না পাওয়ায় তিনিও সমস্যায় পড়েছেন। এ বিষয়ে তিনি জানান, তিন-চার মাস ধরে বাজারে কেরুর চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই রিফাইনারি মিলের চিনি কিনছেন। বাড়ির পাশে চিনিকল, অথচ সেই চিনিকলের চিনির স্বাদ থেকে চুয়াডাঙ্গার মানুষ বঞ্চিত, এ কথা কাউকেই বলা যায় না। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, কেরু কোম্পানি চত্বরে একটি সেল সেন্টার চালু করা এবং সেখানে ভোক্তাদের জন্য চিনি, ভিনেগার ও স্যানিটাইজার বিক্রি করা।’
দর্শনা বাজারের চিনি বিক্রেতা নজরুল ইসলাম জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো চিনিকলের চিনি দীর্ঘদিন ধরে পাওয়া যায় না। বেসরকারি চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরবরাহ করা চিনি বিক্রি করছেন। বৃহস্পতিবার সর্বশেষ প্রতি কেজি ১০৮ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। বাজারে চাহিদা থাকলেও সরবরাহ নেই।
দর্শনায় বর্তমানে বিএসএফআইসি তালিকাভুক্ত ছয়জন পরিবেশক আছেন। তাদের মধ্যে শাহজাহান আলী বলেন, কেরু থেকে সর্বশেষ ৬ মাস আগে ৫০০ কেজি চিনি উত্তোলন করেছিলেন। এরপর ডিসেম্বর মাসে কেরুর বদলে নাটোর চিনিকল থেকে ২৫০ কেজি করে চিনি বরাদ্দ দেয়া হয়। ডিসেম্বরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড থেকে চিনি উত্তোলন না করার কারণ জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, বিএসএফআইসি থেকে বরাদ্দ না দেয়ায় তিনি কেরু কোম্পানি থেকে চিনি উত্তোলন করতে পারেননি। ওই চিনিকল থেকে বরাদ্দ না পাওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, চিনি– সংকটের কারণে সেখান থেকে বরাদ্দ নিতে পারেননি। এ বিষয়ে কেরুর উপব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) বদরুল আলম বলেন, উৎপাদন কমে যাওয়ায় স্থানীয় পরিবেশকদের কয়েক মাস ধরে চিনি সরবরাহ করা হচ্ছে না। উৎপাদিত চিনি সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসারসহ সরকারি দপ্তরের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়। এছাড়া চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের রেশন হিসেবে প্রতিমাসে পাঁচ মেট্রিক টন বিক্রি করা হয়।
এ বিষয়ে কেরুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন জানান, এবার খরার কারণে আখের আশানুরূপ ফলন হয়নি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ক্ষেত থেকে ৩৯ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন আখ সংগ্রহ করা হয়েছে। ক্ষেতে বর্তমানে যে পরিমাণ আখ আছে, তা দিয়ে চলতি মরসুমে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। তবে ক্ষেতে কী পরিমাণ আখ আছে তা তিনি জানাতে পারেননি।