একটি খুনেই তছনছ সাজানো সংসার : মামলার পর তিনজন গ্রেফতার
চুয়াডাঙ্গার তিতুদহে রফিকুলকে হত্যা করতে গোপন বৈঠক করেন বিএনপির দুই নেতা
স্টাফ রিপোর্টার: টিসিবির কার্ড নিয়ে চুয়াডাঙ্গা সদরের তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সম্প্রতি বিরোধ দেখা দেয়। ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মিলন মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনের (টোটন) সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ান সাবেক নেতা রফিকুল ইসলাম মল্লিক। সেই বিরোধ শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় হত্যাকা-ে। গত শনিবার দিবালোকে শতাধিক মানুষের সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রফিকুলকে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহার, ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয় বিএনপির নেতাদের বরাতে জানা যায়, রফিকুলকে হত্যার বিষয়ে আগের দিন দলীয় কার্যালয়ে বৈঠক করেছিলেন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, তিতুদহ ইউনিয়নে টিসিবির পণ্য নিয়ে বিরোধের জের ধরে ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলামকে একদল অস্ত্রধারী গত শনিবার বেলা ১১টায় প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে। হামলা ঠেকাতে এসে রফিকুলের সহোদর শফিকুল ইসলামসহ অন্তত চারজন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে শফিকুলকে সংকটাপন্ন অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলের ফুটেজ এবং বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রফিকুল খুনের ঘটনায় ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মিলন মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনের নাম সামনে চলে এসেছে।
রফিকুল ইসলাম খুনের ঘটনায় তার স্ত্রী নাহিদা খাতুন বাদী হয়ে দর্শনা থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মিলন মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনসহ ৩৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীদের আসামি করা হয়েছে। এজাহারনামীয় আসামিদের মধ্যে তসলিমুজ্জামান সাগর, মান্দার আলী ও বিল্লাল হোসেনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার তিনজনকে রোববার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এসব তথ্য নিশ্চিত করে দামুড়হুদা সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার জাকিয়া সুলতানা জানান, এজাহারভুক্ত অন্য আসামিদের পাশাপাশি খুনের ঘটনায় জড়িতদের ধরতে অভিযান চলছে।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করায় আসামিরা রফিকুল ইসলামকে খুনের জন্য গত শুক্রবার রাতে গিরীশনগর বাজারে স্থানীয় বিএনপির কার্যালয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন। শনিবার বেলা ১১টার দিকে বাদী স্বামীর সঙ্গে তিতুদহ মাঝেরপাড়া মসজিদের কাছে পৌঁছানো মাত্র দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আসামিরা হামলা চালান। বাদীর সামনেই তার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
রফিকুল ইসলামের ছেলে রাব্বী হোসাইন বলেন, ‘৭ মার্চ রাতে বিএনপি অফিসে বৈঠকে উপস্থিত অনেকেই ওই রাতে আব্বাকে খুন করার সিদ্ধান্তের বিষয়টি অবহিত করলেও আব্বা তা গুরুত্ব দেননি। আর দিনের বেলা কেউ খুন করতে পারে, এটা তার ধারণায় ছিলো না।’
আগের রাতেই গোপন বৈঠকে রফিকুলকে হত্যার পরিকল্পনা হয় বলে জানান বৃহত্তর তিতুদহ ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা। তিনি বলেন, ‘রফিকুলকে খুন করা হবে, এমন গোপন বৈঠকের বিষয় শুক্রবার রাতেই জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু খুনের মাস্টারমাইন্ড ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মিলন মিয়া ৩০ বছরের রাজনৈতিক সহকর্মী হওয়ায় রফিকুল তা বিশ্বাস করেননি। আর এই সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েছে মিলন মিয়া।’
একই তথ্য জানান তিতুদহ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি শামসুজ্জোহা মুকুল। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার রাতে গোপন বৈঠকের পর সন্ত্রাসীরা ওই রাতেই ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এলাকায় মহড়া দেন। পরের দিন সকালে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করেন। রফিকুলকে খুনের পর এখন আমাকে এবং ইউনিয়ন কৃষক দলের সহসভাপতি আলতাফ হোসেনকে খুন করা হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে। আমরা জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।’
রফিকুল ইসলাম মল্লিকের ছিল সাজানো সংসার। পোশাক ও স্যান্ডেলের একটি দোকান রয়েছে তার। স্ত্রী নাহিদা খাতুন গিরীশনগর কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার হিসেবে কর্মরত। দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে জেসমিন নাহার রিয়া ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী এবং একমাত্র ছেলে রাব্বী হোসাইন এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন।
বিভিন্ন মাধ্যমে রাব্বী হোসাইনের ভাষ্য, শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিএনপি নেতা মিলন মিয়া ও আবুল হোসেন গিরীশনগরে দলীয় কার্যালয়ে বড়শলুয়া, গরবগাড়া, চাঁদপুর ও ছোট আড়িয়া গ্রামের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে তারা ঘোষণা দেন, রফিকুলকে যদি শেষ করে দেয়া যায়, তাহলে সামনে আর কেউ আসবে না। রাতে পরিকল্পনার পর সকালেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় বলে জানান রাব্বী। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে কোপানোর কারণেই ঘটনাস্থলেই বাবা মারা যান। খুনের পর খুনিরা রক্তাক্ত অস্ত্র নিয়ে পুলিশ ক্যাম্পের সামনে দিয়ে যখন যাচ্ছিলো, তখন টপ টপ করে রক্ত মাটিতে পড়ছিল। অথচ পুলিশ তাদের আটক করতে এগিয়ে আসেনি।’
রফিকুল ইসলামের স্ত্রী নাহিদা খাতুন অভিযোগ করেন, ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগপন্থী সদস্যরা টিসিবির কার্ড নিয়ে অনিয়ম করে আসছিলেন। ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এর প্রতিবাদ না করে যোগসাজশ করে লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পক্ষে প্রতিবাদ করার কারণে তার স্বামীকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। নাহিদা বলেন, ‘আমার চোখের সামনে আমার স্বামীকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। এমনকি মারা যাওয়ার পরও অনেকেই কুপিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। আমি খুনিদের বিচার চাই, ফাঁসি চাই।’
স্বামী খুন হওয়ায় সংসার নিয়েও বিপাকে পড়েছেন নাহিদা। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের শাসনামলে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। দুজন মিলে যখন সংসারটাকে সাজানোর চেষ্টা করছি, তখনই বড় সর্বনাশ হয়ে গেল। এখন ছেলেমেয়ের পড়াশোনার কী হবে? কী করবো জানি না।’
অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত বিএনপির সাবেক নেতা রফিকুল খুনের ঘটনা নিয়ে বিএনপি জরুরি সভা আহ্বান করে। জেলা বিএনপির সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘তিতুদহে যা ঘটেছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। খুনের পেছনে ও সরাসরি হামলায় জড়িতদের বিষয়ে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিতেই আজকের জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে। সভায় থানা পর্যায়ের নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে টিসিবি ও ভিজিএফের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের করণীয় বিষয়েও নির্দেশনা দেয়া হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে মাহমুদ হাসান জানান, কেবল চুয়াডাঙ্গাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় টিসিবির কার্ড নিয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কার্ড তৈরির সময় চরমভাবে পক্ষপাতিত্ব ও দলবাজি করা হয়েছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সরাসরি হস্তক্ষেপে একই পরিবারের অসংখ্য মানুষের নামে কার্ড হলেও বিএনপি বা সমমনা দলের অনুসারী বা সাধারণ গরিব শ্রেণিকে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতেও একই কার্ড বহাল থাকায় সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিরা ফুঁসে উঠেছে। এ জন্য হালনাগাদ তালিকা ধরে কার্ড করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে কার্ডের পরিবর্তে ‘ট্রাক সেল’ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সমাধান করা যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসককে একাধিকবার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হলেও তিনি জানিয়েছেন বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই তার একার পক্ষে কিছুই করার নেই। আবার বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় দ্রুততম সময়ে সমাধান বা পণ্য সরবরাহ স্থগিত রাখার সুযোগ নেই।
এদিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় রফিকুল খুনের ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন জেলা প্রশাসক মো. জহিরুল ইসলাম, জেলা আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মারুফ সরোয়ার। টিসিবির কার্ড নিয়ে বিরোধের জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম সাইফুল্লাহ বলেন, ‘টিসিবির কার্ড নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে উভয় পক্ষকে নিয়ে আমি নিজেও বসেছি। সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু কেউ কাউকে মানে না। সমস্যা হয়েছে ভিজিএফের ভাগাভাগি নিয়ে। বৈঠক হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে, সংঘর্ষ হয়েছে বাইরে।’
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.