উদ্বেগ বাড়াচ্ছে অবৈধ পথে মানব পাচার : দালালের খপ্পরে পড়ে হচ্ছেন অপহরণ ও হত্যারও শিকার
কর্মসংস্থান ও জীবিকার খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমাতে আগ্রহীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে : স্বপ্ন ইউরোপ
স্টাফ রিপোর্টার: দেশে মানব পাচারের ঘটনা ফের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। উন্নততর কর্মসংস্থান ও জীবিকার খোঁজে একদিকে যেমন বিদেশে পাড়ি জমাতে আগ্রহীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তেমনি এ সুযোগের ফায়দা নিতে মানব পাচার সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দালাল চক্রকে কাজে লাগিয়ে সংঘটিত হচ্ছে অবৈধ পথে কর্মী পাঠানো, মানব পাচারের মতো অপরাধ। অনেক ক্ষেত্রে এসব অপরাধ ঘটছে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেও।
তথ্য অনুযায়ী, কর্মসংস্থানের জন্য প্রতি বছর বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন গড়ে অন্তত ১০ লাখ মানুষ। এদেশের কর্মীরা বিদেশে গিয়ে শ্রমশোষণ, নির্যাতন এমনকি অপহরণ ও হত্যারও শিকার হচ্ছেন। মুক্তিপণের দাবিতে বিভিন্ন বন্দিশালায় আটকে রেখে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। আবার সাগরপথে এক দেশ থেকে অন্যদেশে পাঠানোর সময় ঘটছে মর্মান্তিক মৃত্যু। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী ব্রেগার পশ্চিমে আল-আকিলা এলাকা থেকে ২০ জনের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লিবিয়ার রেড ক্রিসেন্ট কর্তৃপক্ষের ধারণা, নিহতরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসন রোধে প্রায়ই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছে জনশক্তি আমদানিকারক দেশগুলো। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রপ্তানি খাত নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বৈশ্বিক তথ্য অনুযায়ী, অভিবাসীর উৎস তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী অভিবাসনের প্রত্যাশায় পাড়ি জমাচ্ছেন ইউরোপের উদ্দেশে। দালালের খপ্পরে পড়ে তাদের অনেকেই অবৈধভাবে ছোট ছোট নৌকায় করে উত্তর আফ্রিকা থেকে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ-উত্তাল ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইউরোপের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন। বিপৎসংকুল এ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণহানি হচ্ছে অনেকেরই। আবার নৌকায় ওঠার আগেই লিবীয় পাচারকারী চক্রের হাতে অপহৃত হয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অনেকে। প্রাণহানিও ঘটছে। কিন্তু প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে আসছে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার ঘটনাটি।
অভিবাসী উদ্ধার তৎপরতা নজরদারি সংগঠন অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মাইগ্র্যান্ট রেসকিউ ওয়াচের রব গোয়ানস তথ্য অনুযায়ী, লিবিয়ার সৈকত থেকে উদ্ধার হওয়া গলিত লাশের সংখ্যা ২০। এরা সবাই বাংলাদেশি বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
এর আগে, ২০২০ সালের ২৭ মে লিবিয়ায় ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ২৬ জনই ছিলেন বাংলাদেশের নাগরিক। লিবিয়ার মানব পাচারকারী এক ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা ওই ৩০ অভিবাসীকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়, এর আগে ২০১৫ সালের ১ মে থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে পাওয়া গিয়েছিল গণকবর। এরপর মালয়েশিয়াতেও পাওয়া যায় গণকবর। আর ওইসব গণকবরে পাওয়া গিয়েছিল অনেক বাংলাদেশির লাশ; যাদের অধিকাংশই পাচারের শিকার হয়েছিলেন।
২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বরে মালয়েশিয়া পাচারের চেষ্টাকালে কক্সবাজারের বাহারছড়া এলাকা থেকে নারী-শিশুসহ ৬৬ জন উদ্ধার করে পুলিশ। এদের সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে একটি বসতঘরে জড়ো করা হয়েছিল। অভিযানে পাচারকারী দলের পাঁচজনকে আটক করা হয়। শুধু মালয়েশিয়া নয়, ইউরোপসহ বিশ্বের নানা দেশেই অবৈধ পথে পাচার হচ্ছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানব পাচারবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী, মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার বিগত বছরের তুলনায় সামগ্রিকভাবে ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আগের মতো দ্বিতীয় ধাপেই (টিয়ার-২) রয়ে গেছে। এই ধাপে বাংলাদেশের প্রতিবেশীদের মধ্যে রয়েছে ভারত, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা। (টিয়ার-২) ধাপ অর্থ যেসব দেশ ন্যূনতম মানদন্ড অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মার্কিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত, বিচার ও দোষী সাব্যস্তকরণ বাড়ানো।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত একযুগে ওমান, বাহরাইন, ইরাক, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, মিসর, রোমানিয়া, ব্র¤œনাই ও মালদ্বীপে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ না হলেও গত বছরের জুলাই থেকেই ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি। একই সময়ে মালদ্বীপের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়াও নিয়মিত বিরতিতে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য ভিসা গ্রহণের পথ রুদ্ধ করে দেয়। মানব পাচারের অভিযোগে সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবের বাংলাদেশীদের জন্য ওমরাহ ভিসা দেয়া বন্ধ করারও নজির রয়েছে। ২০১৭ সালে একইভাবে ভিসা বন্ধের ঘোষণা দেয় বাহরাইন। বারবার অবৈধ অভিবাসন ও মানব পাচারের অভিযোগে এসব দেশে নিয়মিতভাবেই বৈধ ভিসা নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদেরও হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে বিমানবন্দরে কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহার ও হেনস্তার শিকার হওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য ও গণমাধ্যমে মানব পাচার, অবৈধভাবে সাগর পাড়ি এবং অভিবাসন গমনেচ্ছুদের জিম্মি করে অর্থ আদায়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের বাজারেও এখন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশীরা প্রতি বছরই শরণার্থী হিসেবে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন।
জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম এবং জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক দপ্তর যৌথভাবে তৈরি করা ‘ট্রাফিকিং ইন পার্সনস ইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনে দেখা যায় (বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত) ২০২০ সালে যেসব মানবপাচারের ঘটনা শনাক্ত করা গেছে তার বেশিরভাগই ঘটেছে ঢাকা, খুলনা এবং সিলেট বিভাগীয় অঞ্চলে। জেলা হিসেবে বাংলাদেশের সাতটি জেলায় সবচেয়ে বেশি মানব পাচারের ঘটনা বেশি শনাক্ত করা হয়েছে। এসব জেলা হচ্ছে মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং হবিগঞ্জ। এসব জেলা থেকে প্রতি লাখে দেড় জনের বেশি মানুষ পাচারের শিকার হয়। ঢাকা, খুলনা ও সিলেট অঞ্চলের মানবপাচার চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়ার ঘটনা ঘটে খুলনা বিভাগে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ইউরোপে বাংলাদেশীদের শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় প্রার্থনার সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোয় আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন ৪০ হাজার ৩৩২ জন। তাদের মধ্যে আবেদন মঞ্জুর হয়েছে দুই হাজার জনের। মোট আশ্রয়প্রার্থীর ৫৮ শতাংশ আবেদন করেছেন ইতালিতে। আর ফ্রান্সে আবেদন করেছেন ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে ইতালিতে শরণার্থী হিসেবে ঢোকা অভিবাসীদের উৎস দেশের তালিকায় এরই মধ্যে শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। গত বছর দেশটিতে আর কোনো বাংলাদেশীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দেয় ইতালি। বিপুলসংখ্যক জাল নথির কারণে ইতালি সরকার গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি নাগরিকদের অনুকূলে সব ওয়ার্ক পারমিটের বৈধতা স্থগিত করেছে, যা যথাযথ যাচাইকরণ না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। সার্বিয়ার শ্রম ভিসা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসন খাত সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে আলাদাভাবে ব্যাপক মনোযোগের দাবি রাখে। কারণ দেশে অর্থনীতির অন্যতম বড় চালিকাশক্তি এখন রেমিট্যান্স। বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এ খাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সরকারের উচিত টেকসই উন্নয়ন ও স্থিতিশীল শ্রমবাজার গঠনে প্রয়োজনে কমিশন গঠন করে বড় সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া।
অভিযোগ আছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে ঘিরে ওঠা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের প্রভাবশালী চার সাবেক এমপি ও মন্ত্রী। জনশক্তি রপ্তানিতে সিন্ডিকেট গড়ে দেড় বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক এখন আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামালের বিরুদ্ধেও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত চালাচ্ছে। কাশমেরী কামাল অর্বিটালস এন্টারপ্রাইজ ও নাফিসা কামাল অর্বিটালস ইন্টারন্যাশনাল নামে দুটো এজেন্সির লাইসেন্স নিয়েছিলেন। এর মধ্যে কাশমেরী কামালের অর্বিটালস এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে আট হাজার কর্মী বিদেশে গেছে। এসব শ্রমিকের বড় একটি অংশ সেখানে গিয়ে কাজ না পাওয়া ও পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে দুর্বিষহ ও মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করার অভিযোগ তুলেছেন। বর্তমানে প্রতারণার অভিযোগে এ শ্রমিকদের করা মামলা মালয়েশিয়ার আদালতে চলমান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রমবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেষ চার বছরে (২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত) ১ হাজার ৩১টি রিক্রুটিং লাইসেন্স অনুমোদন করে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। যেখানে এর আগের ৩০ বছরে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল ৯৯১টির। অভিযোগ রয়েছে, এসব রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নিয়ে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব খাটিয়ে বিদেশে কর্মী পাঠানোর নামে বিপুলসংখ্যক কর্মীকে পাচার করা হয়েছে। এসব কর্মী শ্রমবাজারে প্রবেশ করে কোনো কাজ না পেয়ে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ অর্থ খুইয়েছে, অন্যদিকে সেখানে যাওয়ার পর নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পাশাপাশি ঘটছে প্রাণহানি ঘটনা।
অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর সম্প্রতি একটি সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ‘দেশে মানব পাচার আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার মধ্যে সচেতনতাও কম। আইনের প্রয়োগ বাড়ানো দরকার। মামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে আসে কম। মানব পাচার একটি আন্তর্জাতিক চক্র। বাংলাদেশ একা কাজ করলে হবে না। যেসব রুট জানা যায়, সেসব দেশে বর্ডার ফোর্স, ইন্টেলিজেন্ট ও ইন্টারপোলের সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। রুটগুলো চিহ্নিত করতে বিভিন্ন দূতাবাস, গবেষকের মাধ্যমে আরো তৎপরতা দরকার। যদি দৃষ্টান্তমূলকভাবে কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়া যায় তাহলে অন্যরাও সচেতন হবে। জিরো টলারেন্স অবস্থান নিতে হবে।’
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.