আলমডাঙ্গার বিএনপি নেতা মীর মহি আর নেই

নিভে গেলো রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের সবচে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: আলমডাঙ্গা বিএনপির বটবৃক্ষ হিসেবে পরিচিত মীর মহিউদ্দীন মারা গেছেন (ইন্নাইলাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন)। দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভুগে গত শুক্রবার দিনগত রাত ২টায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আলমডাঙ্গার রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের সবচে’ উজ্জ্বলতম নক্ষত্র নিভে গেল। গতকাল শনিবার বাদ জোহর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দারুস সালাম কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
পারিবারিকসূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৬/৭ মাস পূর্বে মীর মহিউদ্দীন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। স্ট্রোকে আক্রান্তের বিষয়টি তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে শারীরিক অবস্থা আরও অবনতি হলে নিউরো সাইন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার চিকিৎসাধীন রেখে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব না হলে ইন্ডিয়ায় নেয়া হয়। সেখানেও রোগ নির্ণয় সম্ভব হয়নি। তবে লক্ষণের সাথে বিরল এক রোগের মিল আছে বলে জানানো হয়েছিল। তবে বিরল রোগের চিকিৎসা সম্ভব হয়নি। আক্রান্তের ২৪ ঘন্টার ভেতর অপারেশনের প্রয়োজন ছিল বলে চিকিৎসকদের অভিমত। পরে, দেশে ফিরিয়ে এনে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছিল। ওই অবস্থায় গত শুক্রবার দিনগত রাত ২টায় তিনি মারা যান।
ভোরে লাশ নিজবাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বাদ জোহর গার্ড অব অনার প্রদান ও জানাজার নামাজ শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আলমডাঙ্গা দারুস সালাম কবরস্থানে আব্বা-আম্মার কবরের পাশে তাকেও শায়িত করা হয়। আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মেহেদী ইসলামের উপস্থিতিতে এ গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ পরির্দশক তদন্ত আজগর আলী নেতৃত্বে জেলা পুলিশের এক চৌকস টিম এ গার্ড অব অনার প্রদান করে।
শেষ চৈত্রের তাপপ্রবাহ উপেক্ষা করে মরহুমের জানাযায় উল্লেখযোগ্য মানুষের সমাগম ঘটে। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পৌর প্রশাসক শেখ মেহেদী ইসলাম, জেলা জামায়াতের আমির রহুল আমিন, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফ, জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাড. ওয়াহেদুজ্জামান বুলা, জেলা বিএনপির অন্যতম সদস্য আব্দুর জব্বার সোনা, সরদার আলী হোসেন, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা ফরিদুল ইসলাম শিপলু, সফিকুল ইসলাম পিটু, জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অ্যাড. মাসুদ পারভেজ রাসেল, সাবেক পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম সবেদ আলী, সাবেক পৌর মেয়র হাসান কাদির গনু, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলাল উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. আব্দুর রশিদ মোল্লা, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাসেম মাস্টার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজেদ আলী মাস্টার, উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আক্তার হোসেন জোয়ার্দ্দার, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রোকন, পৌর বিএনপির সভাপতি আজিজুর রহমান পিন্টু, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান অল্টু, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুল ইসলাম, আসিরুল ইসলাম সেলিম, উপজেলা জামায়াতের আমির প্রভাষক শফিউল আলম বকুল, সেক্রেটারি মামুন রেজা, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সদস্য এমদাদুল হক ডাবু, সার ব্যবসায়ী হাজি আকবার আলী, হাজি রফিকুল ইসলাম, হাজি হারুন অর রশিদ, আসিফ আল নুর তামিম, জেলা আঞ্চলিক মোটরমালিক সমিতির সেক্রেটারি সেকেন্দার আলী, উপজেলা ও পৌর বিএনপিসহ যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, অঙ্গ সংগঠনের সকল নেতাকর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
মীর মহি উদ্দীন আলমডাঙ্গা শহরের প্রবীন মিলব্যবসায়ী প্রয়ত আলহাজ মীর খোস্তার আলী ও প্রয়াত আবেদা বেগমের সেজ সন্তান ছিলেন। সহধর্মিণী জিয়াউন নাহার আলমডাঙ্গা মহিলা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। তার দুই কন্যা সন্তান। দু’মেয়েই চিকিৎসক। তারা সার্বক্ষণিক দেখভাল করছেন। মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনায় স্ত্রী জিয়াউন নাহার ও ভাতিজা মীর আসাদুজ্জামান উজ্জ্বল সকলের নিকট দোয়া চেয়েছেন।
বিএনপি নেতা মীর মহিউদ্দীনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শোকবার্তায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আলহাজ মীর মহিউদ্দীনের মৃত্যুতে তার পরিবারবর্গ ও নিকটজনদের প্রতি আমি গভীর সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি। সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের নীতি ও আদর্শ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দর্শনে গভীরভাবে বিশ্বাসী মরহুম আলহাজ মীর মহিউদ্দীন চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপি-কে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। জনপ্রতিনিধি, হিসেবে এলাকার উন্নয়নে তার অবদান ছিল অসামান্য।‘৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তিনি দেশবাসীর নিকট চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দোয়া করি-মহান রাব্বুল আলামীন যেন তাকে জান্নাত নসীব এবং শোকার্ত পরিবারবর্গকে ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান করেন।’ বিএনপি মহাসচিব শোকবার্তায় আলহাজ মীর মহিউদ্দীন এর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যবর্গ, আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়াও শোক জানিয়েছেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারমান সাবেক এমপি শামসুজ্জামান দুদু। শোকবার্তায় তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আলমডাঙ্গা পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও আলমডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক জনপ্রিয় মেয়র জননেতা মীর মহিউদ্দিনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। সেই সাথে মরহুমের তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। অপরদিকে, শোক জানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কর্মাসের সভাপতি ইয়াকুব হোসেন মালিক। তিনি বলেন, বিশিষ্ট্য রাজনীতিবীদ ও ব্যবসায়ী আলমডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক জনপ্রিয় মেয়র মীর মহিউদ্দীনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
এদিকে, মীর মহিউদ্দীনের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে ও তার শোককাতর পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরিফ, সিনিয়র সহসভাপতি আক্তার হোসেন জোয়ার্দ্দার, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রোকন, পৌর সভাপতি আজিজুর রহমান পিন্টু, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ওল্টু, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সদস্য এমদাদুল হক ডাবু। তার মৃত্যুতে জাতীয়তাবাদী শক্তির অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। অনুরূপ পৃথক শোকবার্তা পাঠিয়েছেন জেলা জামায়াতের আমির রুহুল আমিন ও আলমডাঙ্গা উপজেলা আমির প্রভাষক শফিউল আলম বকুল।
আলমডাঙ্গা ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে আকবর আলী, রফিকুল ইসলাম মিয়া, আব্দুল বারী, আসিফ আল নুর তানিম আঞ্চলিক মোটর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার আলী অনুরূপ শোকবার্তা দেন। আলমডাঙ্গা সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে অনুরূপ শোক প্রকাশ করা হয়েছে। মীর মহিউদ্দীন আলমডাঙ্গা বিএনপির অপরিহার্য এক নাম। ভোটের হিসেব নিকেষে নির্ভুল সমীকরণের শিক্ষক ছিলেন মীর মহিউদ্দীন। নেতাকর্মীদের মাঝে হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মত সম্মোহন সৃষ্টি করতে পারতেন।
মীর মহি উদ্দীন আলমডাঙ্গা পৌরসভার দুই ট্রাম মেয়র ছিলেন। ২০০৩ সালে প্রথম বার নির্বাচিত হন। তারপরের বারও তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি পৌরসভাকে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেন। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে শহরে ড্রেন নির্মাণ, পানি সাপ্লাইয়ার প্রক্রিয়া করেন। এছাড়া বাস টার্মিনাল নির্মাণ, জান্নাতুলবাকীনামক পৃথক পৌর গোরস্থান, ক্যানেলে গোসলের জন্য বেশকিছু পাকা ঘাট নির্মাণ, শহীদ মিনার নির্মাণ, স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ করেন। তিনি পৌর শহরে অনেক মসজিদ-,মন্দির নির্মাণ ও পুণর্র্নিমাণ করেছেন। পৌর এলাকা আলোকিত করতে বিদ্যুত সুবিধা দ্বার গোড়ায় পৌঁছে দিতে তিনি ছিলেন অনন্য। সমালোচনা যতই থাক, অন্তত এ সব কাজের জন্য মানুষ তাকে স্মরণ করবেন।
আরেকটি কাজের জন্য আলমডাঙ্গা অঞ্চলে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সেটি হলো- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করা। তিনি আলমডাঙ্গা মহিলা ডিগ্রি কলেজ, আলমডাঙ্গা পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়, এনায়েতপুর বাড়াদী মীর খোস্তার আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আমেনা বেগম প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নির্মাণ করেন। এছাড়াও, বেলগাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চরপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, জগন্নাথপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খাসকররা কলেজ ও জামজামি কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখেন।
নির্দ্বিধায় বলা যায় যে মীর মহিউদ্দীন তার সময়ের অন্যান্যদের চেয়ে অধিক গতিশীল ছিলেন। তিনি এক সাথে বিভিন্ন ধরণের কাজে পারঙ্গম ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন। শিক্ষায়, শ্রমে ও মেধায় তিনি অন্য রাজনীতিকদের চে এগিয়ে ছিলেন বলেই তিনি ছিলেন সবক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সফল্যের অধিকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় তিনি অতিরিক্ত সুবিধা পেতেন। বিশেষ করে মন্ত্রণালয়সহ অফিসিয়াল কাজে। তার অনেক সহপাঠী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে। তিনি কখনও থানায় ও চায়ের দোকানে বসতেন না। এ বৈশিষ্ট্য ছিল প্রশংসনীয়। আইন আদালত ও অফিসিয়াল কাজে তিনি ছিলেন পুরো জেলায় অনন্য। ব্যবসায়ী হিসেবে মীর মহি উদ্দীন ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি বর্তমানে জেলা ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। এক সময় তিনি এ সংগঠণের বিভাগীয় সভাপতি ছিলেন। গত দুই যুগে যারা সারের ডিলার হয়েছেন, তাদের অধিকাংশ মীর মহি উদ্দীনের হাত ধরে।
ব্যবসায়ী হিসেবে যেমন সফল, ঠিক তেমনই দানের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উপোড় হাত। মেয়র না থাকলেও আলমডাঙ্গায় তিনি সবচে বেশি দান করতেন। প্রতি শীত ও ঈদে তিনি কয়েক হাজার দরিদ্রদের কম্বল, শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, শার্ট ও নগদ টাকা বিতরণ করতেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের দরিদ্র পরিবারের মেয়ের বিয়েতে উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা করেছেন। এসব কারণে মীর মহিউদ্দীনের বিকল্প মীর মহিউদ্দীন নিজেই। ধর্মীয় কর্মকা-েও প্রয়াত আলহাজ মীর মহিউদ্দীন ছিলেন অগ্রগামী। তিনি দীর্ঘদিন আলমডাঙ্গা পুরাতন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সভাপতি হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More