চুয়াডাঙ্গার মোমিনপুর বাজার এলাকার বহু ব্যবসায়ীর নিকট থেকে হাতিয়ে নেয়া টাকার পরিমাণ কয়েক কোটি
লগ্নিকারীদের মধ্যে টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে ভর করেছে দুশ্চিন্তা : কেউ কেউ নিচ্ছেন মামলার প্রস্তুতি
এলাকা থেকে ফিরে শামসুজ্জোহা রানা: আদিয়ান মার্ট লিমিটেড নামে ওয়েবসাইট নির্ভর প্রতিষ্ঠান খুলে বহু মানুষকে বোকা বানিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া চক্রের বিরুদ্ধে আরও অসংখ্য মামলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। লগ্নিকারীদের মধ্যে মোমিনপুর এলাকারই কয়েকজন টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়ে বলেছেন, এলাকার মানুষ হয়ে ওরা এভাবে যে প্রতারণা করবে তা বুঝতেই পারিনি আমরা।
আদিয়ান মার্ট লিমিটেডর মূলহোতা জুবাইয়ের সিদ্দিক মানিক। লেখাপড়া শেষ করে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে এলাকায় ফিরে আনুমানিক বছর দু আগে নিজ এলাকা চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের মোমিনপুর বাজারে নিজস্ব বাড়িতেই কার্যালয় খুলে বসেন। কার্যালয়ে সাইনবোর্ড লাগানো হলেও মানুষ ঠকানোর মূল অস্ত্র হয় ইন্টারনেট ওয়েবসাইট। বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য কোম্পানির নির্ধারিত মূল্যের অনেক কমে দেয়ার লোভ দেখিয়ে অগ্রীম টাকা হাতিয়ে নিতে থাকে। টাকা নেয়ার পর ইন্টারনেটের মাধ্যমেই ইনভয়েস দেয়। শর্ত দেয় টাকা পাওয়ার তিন মাস পর ৪ মাসের মধ্যেই পণ্য ক্রেতার নিকট পৌঁছে দেয়া হবে। প্রথমদিকে কিছু লগ্নিকারীকে স্বস্তায় পণ্য দিলেও পরে শত শত লগ্নিকারীর অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পর ছলচাতুরি শুরু করে। দিনের পর দিন ঘুরাতে থাকে। কয়েক মাস আগে কার্যক্রম কমিয়ে দেয়। মাস খানেক ধরে লাপাত্তা হন জুবায়ের সিদ্দিক মানিক। অবশেষে তাকে খুলনা থেকে আটক করে র্যাব। মানিকসহ তার পিতা মোমিনপুরের আবু বক্কর সিদ্দিক, ভাই মাহমুদ সিদ্দিক রতন ও ম্যানেজার মিনারুল ইসলামকে আটক করে র্যাব পুলিশে সোপর্দ করে। চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের বোয়ালমারির উজ্জল হোসেনের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে গত শনিবার আদালতে সোপর্দ করে। একই সাথে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদনও করা হয়। আদালত ৪ জনকেই জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দেন। আজ মঙ্গলবার রিমান্ড শুনানী হবে। এদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর থানার এসআই গোপাল চন্দ্র ম-ল জোর তদন্ত অব্যাহত রেখেছেন। জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মামলার সার্বিক দিক তত্ত্বাবধানও করছেন।
গতকাল সোমবার সরেজমিন মোমিনপুর বাজারে গেলে বাজারের ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলেছেন, এলাকার অসংখ্য মানুষ ওদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এলাকার মানুষ হয়ে এভাবে যে প্রতারণার ফাঁদ পাতবে তা ঘুন্নাক্ষরেও কেউ বুঝতে পারেনি। তাছাড়া মাঝে একবার ওই অফিসে অভিযান চালিয়ে ওদের বিরুদ্ধে কিছু না করার কারনে অনেকের বিশ^াস বাড়ে। মোমিনপুর বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী শ্রী অরুণ শাহ বললেন, আমার প্রতিবেশী ওরা। জুবাইয়ের সিদ্দিক মানিকের পিতা আবু বক্কর সিদ্দিক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে। তিনি হিসেবরক্ষণ অফিসের বড় বাবু ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি মোমিনপুর বাজারে সারের ব্যবসা শুরু করেন। বড় ছেলে জুবাইয়ের সিদ্দিক মানিক ঢাকায় চাকরি করতেন। বছর দু আগে বাড়ি ফিরে ওই কোম্পনি খুলে পিতাকে ব্যবসার পরিচালক বানালো। ছোট ভাই মাহমুদ সিদ্দিক রতনকে করলো ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সারের দোকানের ম্যানেজার সরিষাডাঙ্গার মিনারুলকে কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার করলো। প্রতিবেশীদের কোম্পানি ভেবে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ কেনার জন্য ওদের হাতে তুলে দিলাম তিন লাখ টাকা। এ টাকা ফেরত পেতে এখন মামলা ছাড়া উপায় নেই। অভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করে মোমিনপুর বাজারেরই চা দোকানি আবুল হোসেন বললেন, ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ঋণ করে ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার মত চা দোকানিকে ওরা ঠকাবে না। টাকা নিয়ে আত্মসাত করেছে। ঋণের বোঝা টানবো নাকি ওদের বিরুদ্ধে মামলা করে ছুটবো? এসব ভেবে দিশেহারা। বাজারেরই অপর ব্যবসায়ী মুজিবুল হক বললেন, ওরা ৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। টাকা যখন নিলো তখন বলেছিলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এলাকার গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ করা হবে। হচ্ছে হবে করে কয়েক মাস কটে গেলো। পণ্য দেয়ার দাবি নিয়ে গেলে জুবায়ের সিদ্দিকীকের পিতা আবু বক্কর সিদ্দিক উল্টো খারাপ আচরণ করতেন। বলতো যখন খুশি তখন পণ্য দেয়া হবে। বাড়াবাড়ি করলে কিছুই পাবি না। পারলে মামলা কর। মামলা করলে উল্টো তোদেরই টাকা খরচ হবে।
এলাকার কিছু ঘরবাড়ি প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে লাগানো রয়েছে আবু বক্কর সিদ্দিকের ছবিসহ চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রচার প্রচারণার পোস্টার। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদের আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন তিনি। চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করে অনেকের কাছেই তিনি বলতেন, যখন যেটা করেছি তখন সেটাই হয়েছে। চেয়ারম্যান পদে ভোট করেও নির্বাচিত হবো। এরই মাঝে যখন প্রতারণার অভিযোগে পিতা পুত্রসহ ৪ জনের গ্রেফতার হওয়ার খবর এলাকায় ছড়িয়েছে তখন তাকে নিয়ে হাস্যরসের গল্প শুরু হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, যখন হিসাবরক্ষণ অফিসের বড় বাবু তখনও টাকার দম্ভ ছিলো। সারের ব্যবসাও করেছে অনেকটা একচটিয়া। ছেলে এসে কোম্পানি খুলে মানুষের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া শুরু করলে তিনি টাকার গরমে ধরাকে সরাজ্ঞান করে বসেছিলেন। দাম্ভিক আবু বক্কর সিদ্দিক ও তার দু ছেলের নিকট থেকে গ্রাহকদের লগ্নিকৃত টাকা কি উদ্ধার হবে? এরকম প্রশ্ন তুলে অনেকেই বলেছেন, বেশকিছুদিন আগেই র্যাব’র কাছে মৌখিকভাবে নালিশ করা হয়েছিলো। গাংনী ক্যাম্প ছায়া তদন্তও শুরু করেছিলো। পন্য দেয়া দূরের কথা টাকা ফেরত চাইতে গেলে যখন উল্টো আচরণ শুরু করে তখনই মামলার পথে হাটতে বাধ্য হন লগ্নিকারীরা।
র্যাব প্রাথমিক তদন্তে জেনেছে প্রায় ১৮শ এনভয়েস বাকি রয়েছে। এর বিপরীতে পণ্য দিতে হলে বহু টাকা প্রয়োজন। গ্রাহকদের নিকট থেকে নেয়া টাকা কোথায় রেখেছে তা জানারও চেষ্টা চলছে। অর্থলগ্নি করে প্রতারিতদের আইনের আশ্রয় নেয়া প্রয়োজন।