আজ ১ আষাঢ় : চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহি গড়াইটুপি মেলার মাঠের চারিপাশ সুনশান : নিরবে নিঃশব্দে অতিবাহীত ৪টি আষাঢ়
বেগমপুর প্রতিনিধি : মেলার আক্ষরিক অর্থ ‘লিমন। মেলার নামে সবার মন এক অভূতপূর্ব আনন্দের উচ্ছ্বাসে ওঠে নেচে। মেলার আনন্দের স্মৃতি সকলের মনেই থাকে গভীরভাবে মুদ্রিত। মেলা পর¯পরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও ভাব-সম্মিলনের সংযাগে সেতু। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রাম্য মেলার গুরুত্ব তাই অসীম। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মিলনের মধ্যে যে সত্য তা কেবল বিজ্ঞান নয়, তা আনন্দ তার স্বরূপ তা প্রেম। তা আংশিক নয়, তা সমগ,্র কারণ তা কেবল বুন্ধিতে নয় তা হৃদয়কেও পূর্ণ করে। বিশেষ কোন পর্ব উপলক্ষে মেলার প্রচলন হলেও এখন গ্রামীণ-জীবনে এটি একটি স্বাভাবিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। সাধারণত বছরের শেষে অথবা বছরের শুরুতে এই মেলা বসে অথবা বিশেষ কোন পর্ব উপলক্ষেও মেলার আয়াজেন করা হয়ে থাকে। তেমনি একটি চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী গড়াইটুপি মেলা। মেলার মাঠকে কেন্দ্র করে আশপাশ এলাকাজুড়ে পড়ে যেত সাজসাজ ভাব। নারী, পুরুষ, শিশুদের কলরবে মুখরিত হয়ে উঠত গোটা এলাকা। ৪৫টি জেলার মানুষ পরসা সাজিয়ে বসত মেলা মাঠের আঙ্গিনা জুড়ে। সুচ থেকে শুরু করে সবই পাওয়া যেত এ মেলাতে। কেনা কাটার পাশাপাশি বিনোদনের জন্য আয়োজকরা রাখতেন নানা ধরণের চিত্তবিনোদন। আর বিরতিহীন ভাবে চলত এসব কিছুই। মানুষের পদচারণা আর ঝলমলে আলোর বাতিতে আলোকিত হয়ে উঠত মেলার মাঠের আশপাশ গ্রাম। ইজারা না হওয়ায় ৪টি আষাঢ় কেটে গেলো নিরবে নিঃশব্দে। সেই সাথে ৫শ বছরের ইতিহাস আজ হতে চলেছে বিলুপ্তি। পাশাপাশি সরকার ২ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে হয়েছে বঞ্চিত। এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তি প্রজন্মের নিকট ঐতিহ্যবাহি গড়াইটুপি মেলার ইতিহাস ঐতিহ্য একদিন হয়ে উঠবে রূপ কথার কল্পকাহিনী। তবে উপলক্ষ যাই হাকে না কেন মেলা বাঙালি সমাজ মানুষের নিকট খুব জনপ্রিয় ও আনন্দের দিন। মেলায় সমাজের সর্ব শ্রেণীর মানুষ এসে মিলিত হন। বিভেধের পার্থক্য ভুলে গিয়ে সকলেই এক আনন্দের জোয়ারে গা ভাসায়। মেলাকে আশ্রয় করে গ্রামীণ মানুষের আনন্দ-উৎসের রুদ্ধ দুয়ার খুলে যায়। এর মধ্যেই সে খুঁজে পায় বেঁচে থাকার সার্থকতা। খুঁজে পায় মুক্তির আনন্দ।
প্রতি বছর আষাঢ়ের আগে ভাগেই চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের গড়াইটুপি, খাড়াগোদা আর গোলাপনগ গ্রামের মধ্যবর্তী মাঠের বটগাছের নিচে বসতো ৭দিনের মেলা। গড়াইটুপির এ মেলাকে মানুষ বিভিন্ন নামে ডাকত। যে নামেই ডাকুক না কেন মেলা প্রাঙ্গণ মানুষের পদচারনায় মুখোরিত হয়ে উঠত আষাঢ় এলেই। প্রথম কার্যদিবস ৭ই আষাঢ় হলেও এর অনেক আগে থেকেই সার্কাস, যাত্রাপালা, পুতুল নাচ, হরেক রকম দোকানপাট, গৃহস্থলীর জিনিসপত্রর দোকান, কাঠের তৈরী আসবাবপত্রর দোকান, খাবারের হোটেলসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি দোকানের পরসা সাজিয়ে বসত স্থানীয় লোকজনসহ দেশের ৪৫টি জেলার মানুষ। প্রথম দিবসটি জাকজকমপূর্ণ করতে আগেভাগেই আয়োজক কর্তৃপক্ষ দোকান পাট বসানোর পাশাপাশি প্রচার প্রচারানা আর আলোক সজ্জা করত যথাসাধ্য। সব মিলিয়ে এলাকা জুড়ে উৎসব মুখোর পরিবেশ বিরাজ করত। আর মেলাটি ধর্মপ্রচারক খাজা মালিক-উল-গাউছের মাজারকে কেন্দ্র করেই দীর্ঘ ৫ শ বছর থেকে চলে আসছে বলে এলাকার প্রবীন জনেরা জানান। আর প্রতœত্বতœ বিদরা মনে করেন, ১৪১৯ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ৫শ ৯৭ বছর আগে খানজাহান আলী ভৈরব নদী পথে দিল্লী থেকে খুলনা বাগেরহাটে আসেন। তিনি খুলনা বাগের হাটে পৌছানোর আগে কালুপোল রাজার ভিটা নামক স্থানে অবস্থান করেন। সেখানে তার ৪ জন অনুসারির মধ্যে খাজা মালিক-উল-গাউছ ছিলেন অন্যতম। আর তিনি চলে যাবার সময় দায়িত্বটা তাকেই দিয়ে যান এমনটাই মনে করেন এলাকাবাসি। মালিক-উল-গাউছ রাজার ভিটা ছেড়ে গড়াইুটপি মেলার মাঠের বটগাছের নিচে আস্তানা গড়ে তোলেন। তখন থেকে তার কাছে বিভিন্ন লোকজন যাতায়াত করতে থাকে। মৃত্যুর পর মালিক-উল-গাউছের শলীল সমাধি বটগাছের নিচেই করা হয়। যদিও বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। পরে তার অনুসারিরা কবরকে (মাজার) ঘিরে মনের বাসনা পুরণে মান্নতসহ কবর জিয়ারত করতে থাকে। সেই থেকে আষাঢ় মাসের ৭ তারিখ এলেই মাজারকে কেন্দ্র করে মানুষের পদচারণা বেড়ে যায়। ৯০ দশের দিকে শূণ্য দশমিক ৪৭ একরের এ খাস জমিটি বানিজ্যিক ভাবে সরকার খ-কালিন ইজারা দেয়া শুরু করে। তবে গড়াইটুপির এ মেলা কবে কখন শুরু হয়েছে সে ব্যাপারে দুনিদৃষ্ট কেউ দিন খন বলতে না পারলেও দীর্ঘদিন থেকে এলাকার মানুষের বিনোদনের খোরাক হিসাবে আনন্দ দিয়ে আসছে এ মেলা। শুরুর আগে থেকেই মেলার আশপাশ এলাকায় বেঁচা বিক্রীর পরসা সাজিয়ে বসে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দোকানিরা। সেই থেকে সামান্য জমি ইজারা দিয়ে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় করে থকে সরকার। আর ইজারার মাধ্যমে ইজারাদাররা মেলার আয়োজন করে থাকে। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে সরকার মেলার স্থানটি ইজারা দিয়ে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা রাজস্ব পায়। সে হিসাবে গত ৪ বছর স্থানটি ইজারা দিতে না পেরে সরকার প্রায় ২ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সেই সাথে এলাকাবাসি বঞ্চিত হয়েছে বিনোদন থেকে। মেলাটি অনুষ্ঠিত না হবার পিছনে স্থানীয় রাজনীতি নেতৃত্ব আর কতৃত্ব দায়ি বলে এলাকাবাসি মনে করেন। কারণ স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। তার পর থেকে ওই মূল্যে আর কেউ ইজারা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। তারি ধারাবাহিকতায় চলতি বছরও ইজারা দিতে পারেনি সরকার। সরকার কয়েকবার ইজারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও তাতে সাড়া মেলে না। ফলে মেলা না বসায় গত ৪টি আষাঢ় নিরবে নিঃশব্দে অতিবাহিত হবার পথে। করোনা পরিস্থিতির কারণে চলতি বছর তো কোন ভাবেই মেলা অনুষ্ঠিত হবার নয়। সেই সাথে ইজারাদারকে লোকশানের পাশাপাশি নানা ঝুটঝামেলা মোকাবেলা করতে হয়। এ মেলাকে কেন্দ্র করে মামলার আসামি হতে হয়েছে অনেককে। যা এখনও চলমান রয়েছে। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের দু’পক্ষের বিরোধের কারণেই নাকি এমনটি হয়েছে। যার কারণে ঐতিহ্যবাহী গড়াইটুপির মেলা আজ ঐহিত্য হারাতে বসেছে। ইউপি চেয়ারম্যান আকতার হোসেন বলেন, বিগত ৩ বছর হয়নি সরকার তার ন্যায্য ইজারা না পাবার কারণে। ইজারা হলেও করোনা পরিস্থিতিতে কোন ভাবেই অনুষ্ঠিত হতো না। এক দিকে কোরনা পরিস্থিতি অন্য দিকে ইজারা না হওয়ার কারণে জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য আজ বিলপ্তির পথে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান বলেন, যে কোন মেলাই মানুষের বাড়তি বিনোদনের খোরাক জোগায়। শুনেছি এ জেলাতে গড়াইটুপিতে একটি ঐতিহাসিক মেলা বসে। যা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ইজারা হয়ে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন ভাবেই জনসমাগম ঘটবে এমন আয়োজন সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। বর্তমানে মানুষ কি ভাবে বেঁচে থাকবে সেটা নিইয়েয় চিন্তিত। মেলার কথা তো ভাবাই যায় না। এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তি প্রজন্মের নিকট ঐতিহ্যবাহি গড়াইটুপি মাঠে বসা মেলা রূপ কথার গল্প কাহিনি হয়ে দাড়াবে।