আলমডাঙ্গার রায়লক্ষ্মীপুরের দুই কয়েদির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে প্রস্তুত যশোর কারাগার
রায়লক্ষ্মীপুর থেকে ফিরে আলম আশরাফ/শামসুজ্জোহা রানা: আলমডাঙ্গার রায়লক্ষ্মীপুর গ্রামের আজিজুল ও মিন্টুর প্রাণভিক্ষার জন্য রাষ্ট্রপ্রতির কাছে আবেদন করা হয়েছিলেন। সে আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তাই তাদের মৃত্যুদ- কার্যকর করতে আর কোনো বাধা নেই। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে আগামী সোমবার আজিজুল ও মিন্টুর ফাঁসি কার্যকর করা হবে। ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছুনোর জন্য অ্যাম্বুলেন্স ও কফিন ঠিক করে রাখা হয়েছে। সেমাবার রাত পৌনে ১১টায় ফাঁসি কার্যকরের পর মরদেহ বাড়িতে নেয়া হবে। ফাঁসি কার্যকর করা হবে এমন খবর জানেন না আজিজুল ও মিন্টুরবৃদ্ধ মা-বাবা। গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে আজিজুল ও মিন্টুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তাদের পিতা-মাতা অনেকটা স্বাভাবিক। তারা জানেন না যে তাদের সন্তানের ফাঁসি কার্যকর হয়ে যাবে। তাদের পিতা-মাতার ধারণা আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে ছেলের প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছি, হয়তো ছেলে ফিরে আসবে। তারা সাংবাদিক দেখে প্রশ্ন করেন আমাদের ছেলে কি বাড়িতে ফিরে আসবে? কয়েকদিন আগে আত্মীয়স্বজনসহ গ্রামের অর্ধশতাধিক লোকজন আজিজুল ও মিন্টুর সাথে দেখা করেছেন। আজ শনিবার আবারও দেখা করতে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবেন আজিজুল ও মিন্টুরমা-বাবাসহ অনেকই।
চুয়াডাঙ্গা আদালতসূত্র ও মামলার বিবরণীতে জানা যায়, আলমডাঙ্গা থানার জোড়গাছা গ্রামের কমেলা খাতুন ও তার বান্ধবী ফিঙ্গে বেগমকে ২০০৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রায়লক্ষ্মীপুর গ্রামের মাঠে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে তাদের দুজনকে ধর্ষণ করা হয় বলে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধের পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলা কাটা হয় ওই দুই নারীর। এ ঘটনায় খুনের পরদিন নিহত কমেলা খাতুনের মেয়ে নারগিস বেগম আলমডাঙ্গা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় দ-প্রাপ্ত ওই দুজনসহ চারজনকে আসামি করা হয়। অপর দুজন হলেন একই গ্রামের সুজন ও মহি। মামলা বিচারাধীন অবস্থায় মারা যান আসামি মহি। ২০০৭ সালের ২৬ জুলাই চুয়াডাঙ্গার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল সুজন, আজিজ ও মিন্টুকে মৃত্যুদ-ের রায় দেন। এরপর আসামিপক্ষের লোকজন হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১২ সালে ১১ নভেম্বর নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখার আদেশ দেন হাইকোর্ট। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ দুই আসামির রায় বহাল রাখেন এবং অপর আসামি একই গ্রামের বাবর আলীর ছেলে সুজনকে খালাস দেন। এ বছরের ২০ জুলাই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান সুজন। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুজন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চান, কিন্তু তা নামঞ্জুর হয়। ৬ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে কারা অধিদফতরকে চিঠি দেয়। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার ৮ সেপ্টেম্বর সেই চিঠি গ্রহণ করে।
আজিজুলের পারিবারিক পরিচয়: চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাসকররা ইউনিয়নের রায়লক্ষ্মীপুর বাগানপাড়ার বদর ম-ল ওরফে বদর ঘটক ও রাসুলা খাতুনের ছেলে আজিজুল ওরফে আজিদ ওরফে আজিজ। তিনি পেশায় দিনমজুর ছিলেন। আজিজুলরা তিনভাইয়ে মধ্যে তিনি সবার ছোট। বড়ভাই শভা ম-ল ও মেজভাই আব্দুর রশিদ। তারা সবাই নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। নিজের কোনো জমিজমা না থাকায় বৃদ্ধ বদর ঘটক ঘটকালি ও অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করেন। আজিজুল বিয়ে করেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ জলিবিলা গ্রামের সুন্দরী খাতুনকে। তাদের রয়েছে এক ছেলে ও এক মেয়ে। আজিজুলের স্ত্রী সুন্দরী খাতুন বছর পাঁচেক আগে অন্যত্র বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। ছেলে সজিব মিয়া (২০) ও মেয়ে সিমা খাতুন (১৮) নানা বাড়ি জলিবিলা গ্রামের থাকেন।
মিন্টুর পারিবারিক পরিচয়: একই গ্রামের আলীহিম ও আমিরুন খাতুনের ছেলে মিন্টু ওরফে কালু। তিনিও পেশায় দিনমজুর ছিলেন। দুইভাই ও দুই বোনের মধ্যে মিন্টু তৃতীয়। বড়ভাই শুকচাঁন ম-ল ওরফে ফেন্টু। বড় বোন আলিমন খাতুন ওরফে উলি এবং ছোট বোন আনজিরা খাতুন। তারা সবাই বিবাহিত। মিন্টুর পিতা শারীরিক প্রতিবন্ধী; ছোট একটি মুদি দোকান দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। মিন্টু বিয়ে করেন নাগদাহ ইউনিয়নের বারোঘরিয়া গ্রামের বেদেনা খাতুনকে। তাদের রয়েছে একমাত্র মেয়ে। স্ত্রী বেদেনা খাতুন ঘটনার বছর তিনেকের মাথায় অন্যত্র বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। মেয়ে রিপা খাতুন নানাবাড়ি থেকেই বড় হয়েছেন। বিয়েও দেয়া হয়েছিলো রিপা খাতুনকে। কিন্তু সংসার বেশিদিন টেকেনি। তালাকপ্রাপ্ত হয়ে নানা বাড়িতেই থাকেন রিপা।
আজিজুল ও মিন্টুর সব বিষয়ে তদারকি করছেন খাসকররা ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান রুন্নু। তিনি জানান, সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু সেটি নামঞ্জুর করেছেন তিনি। তারপর থেকে ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। জেলারের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারি আগামী ৪ অক্টোবর সোমবার রাত পৌনে ১১টায় ফাঁসি কার্যকর করা হবে। বিষয়টি জানতে পেরে কয়েক দিন আগে তাদের বৃদ্ধ মা-বাবা ও ভাইবোনসহ আত্মীয়স্বজনদেরকে যশোর কারাগারে আজিজুল ও মিন্টুর সাথে সাক্ষাৎ করিয়েছি। আগামীকাল (আজ শনিবার) আবারও যশোর কারাগারে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে। রুন্নু আরও বলেন, আত্মীয়স্বজনদের অনেকে জানলেও মা-বাবা জানেন না সোমবার আজিজুল ও মিন্টুর ফাঁসি কার্যকর করা হবে। তাদের ফাঁসি দিনধার্য করা হয়েছে এমন কথা জানতে পারলে হয়তো বৃদ্ধ মা-বাবা নিজেদের সামলাতে পারবেন না। তাই মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয়েছে; হয়তো ফাঁসি মওকুফ হতে পারে। বৃদ্ধ পিতা-মাতা সেই আশায় আছেন।