আগুনে পুড়লো প্রায় ৩শ বিঘা জমির পানবরজসহ ভুট্টাক্ষেত

আলমডাঙ্গার খাদিমপুরে ভুট্টার ডাটা পোড়ানো আগুন থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

মুন্সিগঞ্জ/খাদিমপুর প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলায় অগ্নিকা-ে প্রায় ৩শ বিঘা জমির পানবরজসহ ভুট্টাক্ষেত পুড়ে ছাই হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের দাবি, এতে অন্তত ৫ কোটির টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার উপজেলার খাদেমপুর ইউনিয়নের বানাতখাল মাঠে এ অগ্নিকা- ঘটে। খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিসসহ চারটি ইউনিট প্রায় ৫ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

স্থানীয়রা জানান, সকালে ভুট্টাক্ষেতের পরিত্যাক্ত ভুট্টাগাছে কেউ আগুন ধরিয়ে দেয়। এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের মাঠসহ পান বরজে। মাঠের পাশের বানাত খালে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণ আনতে ফায়ারসার্ভিস কর্মীদের বেগ পেতে হয়। পরে স্থানীয় সেচ পাম্প দিয়ে পানি তুলে আগুন নিয়ন্ত্রণে নেয় ফায়ার সার্ভিস। আলমডাঙ্গা উপজেলা খাদিমপুরে কৃষকের চোখের সামনে তাদের একের পর এক পানের বরজ ও ভুট্টাক্ষেত আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে আলমডাঙ্গা উপজেলার খাদিমপুর ইউনিয়ন বানাতখাল নামক মাঠে এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। কে বা কারা ভুট্টাগাছ পোড়ানোর সময় পার্শ্ববর্তী পানের বরজে আগুন লেগে মুহুর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

খাদিমপুর ইউনিয়নে ইউপি সদস্য শিমুল হোসেন বলেন, প্রায় ৩শ বিঘা জমির পানবরজ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দুপুরের দিকে কে বা কারা ভুট্টা ডাটা পুড়াচ্ছিলো। ওই সময় বাতাসের বেগে মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে যায়। সে কারণে প্রায় শতাধিক কৃষকের ৩শ বিঘা পানের বরজ ও ভুট্টাক্ষেত পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এতে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

স্থানীয়রা জানান, মাঠের পাশে বানাতখালে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণ আনতে বিপাকে পড়েন ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা। পরে বরজের সেচ পাম্প দিয়ে পানি তুলে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেন ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা।

এদিকে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে তীব্র তাপদাহ। চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। প্রচ- তাপমাত্রার সাথে বাতাসের গতি বেগের কারণে আগুন মুহূর্তেই ৩শ থেকে সাড়ে ৩শ বিঘা পানের বরজ এবং ১০ বিঘা ভুট্টা পুড়ে ভস্মীভূত হয়। ভুক্তভোগী কয়েকজন কৃষক জানান, শিয়ালমারী গ্রামের কতিপয় চাষি তাদের ভুট্টার ডাটা পোড়ানোর উদ্দেশ্যে তাদের জমির ডাটায় আগুন লাগায়। কিন্তু বাতাসের কারণে আগুন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এদিকের জনপদের প্রধান অর্থকারী ফসল হচ্ছে পানবরজ। এই ভয়াবহ অগ্নিকা-ের কারণে কয়েকটি গ্রামের পানচাষি এখন পথে বসার অবস্থা।

কৃষক শাহিন হোসেন বলেন, আমার পানবরজ ছিলো এক বিঘা। আজ আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এখন পথে বসার অবস্থা মতো।

কৃষক রশিদ বলেন, যে জমি লিজ নিয়ে পানের আবাদ করেছিলাম তা আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন কি করে জমির মালিককে টাকা দেবো। আমার পানবরজে এখনও লাখ টাকার মত পান ছিলো।

কৃষক জাহাঙ্গীর বলেন, আমি নিম্নবিত্ত একজন মানুষ। ধার দেনা ও কিস্তিতে টাকা তুলে পানের বরজ করেছিলাম। পানের বরজ পুড়ে যাওয়ায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কৃষক মালেক জানান, এই পানের বরজই ছিলো একমাত্র আয়ের উৎস। সেটা চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। কিছুই করতে পারলাম না। এখন পরিবার নিয়ে কি করে খাবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।

হাফিজুল জানান, ১০ মিনিটের মধ্যে পুরো মাঠে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ৩শ বিঘার ওপরে পানের বরজ পুড়ে গেছে। সেখানে আমার ছিলো ২ বিঘা পান ও ২ বিঘা ভুট্টা সব পুড়ে গেছে।

কৃষক রফিক জানান, আমার ১৫০ পিল পানের বরজ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার পান বরজে এখনো দেড় লাখ টাকার মতো পান ছিলো। সবই পুড়ে গেছে।

কৃষক জসিম জানান, আমার ছিলো ৩ বিঘা পানের বরজ। আজ আমি নিঃস্ব। আমার পান বরজে এখনও ২ লাখ টাকার বেশি পান ছিলো। সব পুড়ে গেছে।

কৃষক আশাবুল হোসেন জানান, আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত। আমার এক ছেলে দুই মেয়ে। আমি দিন আনি দিন খাই। আমার ১০ কাটা জমি লিজ নিয়ে পান চাষ করি। কিন্তু আজ আমার সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে। আমার কি করে দিন চলবে।

কৃষক জলিল জানান, আমি পানের হাটে পান বিক্রি করতে গিয়েছিলাম। আমি হাটে থেকেই শুনতে পারলাম আমার পান বরজে আগুন লাগছে। আমি হাট থেকে সোজা পানবরজে চলে আসি। এসে দেখি আমার বরজে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।

পাঁচকমলাপুর ক্যাম্পের এএসআই আনোয়ার হোসেন জানান, এই এলাকাটি পান চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। যার ফলে এ এলাকার মাঠে শত শত বিঘা জমিতে পানের বরজের মাধ্যমে পানের আবাদ হয়।

স্থানীয়রা জানান, আগুন লাগার পর নিজেরা নিজেদের মতো আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে একের পর প্রায় ৩০০ বিঘা পান বরজে ছড়িয়ে পড়ে।

খাদিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোজাহিদুর রহমান জোয়ার্দ্দার বলেন, খাদিমপুর-বানাত খাল ও শিয়ালমারী গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে একটি ভুট্টাক্ষেতে কেউ আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে আগুন ছড়িয়ে পড়লে সাড়ে ৩০০ বিঘা জমির ভুট্টা ও পানবরজ পুড়ে গেছে। সাধারণ মানুষ কৃষক ও ফায়ারসার্ভিস কর্মীদের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন অফিসার জাহাঙ্গীর আলম সরকার জানান, বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে দুটি ইউনিট গিয়ে আমরা কাজ শুরু করি। পরে আলমডাঙ্গা থেকে আরও দুটি ইউনিট এসে ৪টি ইউনিট মিলে দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।

সংবাদ পেয়ে আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রনি আলম নূর, চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফিসার, আলমডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সোহেল রানা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন ও ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের সঙ্গে কথা বলেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রনি আলম নূর বলেন, খাদিমপুরের বানাতখালী মাঠে কে বা কারা ভুট্টাক্ষেতে আগুন দিলে সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। বাতাসের কারণে আগুন ভুট্টাক্ষেত থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে মাঠের প্রায় ২শ থেকে ৩শ বিঘা পানবরজ পুড়ে যায়। কেউ যদি আগুন লাগিয়ে থাকে থানা পুলিশ খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে বলেছি, যেনো কোনোপ্রকারে আগুন দিয়ে ভুট্টাক্ষেত পরিস্কার না করা হয়। মানুষ সচেতন হলে এরকম অগ্নিকা-ের ঘটনা আর ঘটবে না। যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য সরকার দেখবে। সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বাড়াদী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আলমডাঙ্গার আঠারোখাদা গাড়পুবির নামক মাঠে ভুট্টার নাড়া পোড়াতে গিয়ে ভুট্টার জমিতে আগুন লেগে ভষ্মীভূত হয়েছে। গতাকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে আলমডাঙ্গার আটারোখাদা গ্রামের রেজাউল হকের ছেলে লালন নিজ জমির ভুট্টার নাড়া পোড়াতে গিয়ে পাশেরক্ষেতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় গ্রামের মধ্যে খবরটি জানাজানি হলে মসজিদের মাইকে প্রচার দিলে লোকজন দ্রুত গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ততক্ষণে গ্রামের উম্বাত শেখের ছেলে কিতাবের ১ বিঘা, নুরুদ্দিনের ছেলে আবু তালেবের ৫ কাটার মত ভুট্টাক্ষেতে আগুন লাগে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী আবু তালেব জানান, আমার ভুট্টা বাড়িতে আনার জন্য কাজ চলছে। কাজ শেষে আমরা বাড়ি আসি। কিছুক্ষণ পরে মাইকে শুনতে পারি মাঠে আগুন লেগেছে। গিয়ে দেখি ভুট্টা পুড়ে গেছে। এদিকে আলমডাঙ্গার হাটবোয়ালিয়াতে আগুনে পুড়েছে পানের বরজসহ বাঁশবাগান। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে হাটবোয়ালিয়া হাফিজিয়া মাদরাসার পাশে পানবরজে এই ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। পান বরজের সাথে লাগুয়া দৈনিক মাথাভাঙ্গার প্রতিনিধি সাংবাদিক সোহেল হুদার বাড়ি। এসময় সাংবাদিক পত্নীর চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে এবং প্রতিবেশীদের আধাঘণ্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ততক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখায় পানেরবরজ পুড়ে যায়। কিন্তু ওই সময় সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ দূরুত্বে সরিয়ে নেয়া হয়। ভুক্তভোগী পান বরজের মালিক হাটবোয়ালিয়া গ্রামের সমরুল হুদার ছেলে জুয়েল হুদা জানান, আমার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার টাকার মতো। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে আগুনের সূত্রপাত সিগারেটের আগুন অথবা পটকার আগুন থেকেই হতে পারে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More