পরিবহনসহ নানা সঙ্কটে মেহেরপুরের আম-লিচু চাষিরা
স্টাফ রিপোর্টার: করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বাংলাদেশে কার্যত যে লকডাউন চলছে, এতে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে আম-বাগানের মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এদিকে বৃষ্টি ও ঝড়ের কারণে বাগান মালিকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এরপরও সময়মতো সব আম বিক্রি করতে পারবেন কি না সেটা নিয়ে তারা সংশয়ে আছেন। কারণ দেশজুড়ে কার্যত লকডাউন চলছে। অপরদিকে, মধু মাসের মধু ফল আম ও লিচু উঠতে শুরু করেছে মেহেরপুরের বাজারে। তবে করোনার প্রভাবে বাইরের জেলা থেকে আসছে না কোনো পাইকার ব্যবসায়ী। ফলে হতাশায় আম ও লিচুচাষিরা। ফল ব্যবসায়ীরা বলছেন আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরা বন্ধ থাকায় বাইরের জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা আসতে চাচ্ছেন না মেহেরপুর জেলায়। সাথে রয়েছে পণ্য পরিবহন সঙ্কট। আর কৃষি বিভাগ বলছে, ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর জেলাতে ১৮৭৫ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছিলো। চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ১৯৭৫ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে আরও বেশি জমিতে আম চাষ হচ্ছে। মূলত আম চাষ লাভজনক হওয়াতে জেলার কৃষকরা আম চাষে ঝুঁকছেন।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কেশবপুর গ্রামের মাঠে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ২০১২ সালে ৪০ লাখ টাকায় ৭০ বিঘা বর্গা জমি লিজ নিয়ে ১০ হাজার পিচ আমের চারা রোপণ করে বাগান তৈরী করেন আবুল কালাম, জাহাঙ্গীর হোসেন, সামসুল আলম, রফিকুল ইসলাম ও আব্দুল গনি। বাগানের প্রতিটি ডালে ঝুলছে থোকা থোকা আম। কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলো হবে পরিপুষ্ট। বৈশাখ শেষে আমগুলো গাছ থেকে নামানো শুরু হবে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের পরিচর্যা। তবে মুখে হাসি নেই আমচাষি ও বাগান মালিকদের। চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে লোকসানের শঙ্কায় দিন কাটছে তাদের। বাগান মালিকরা জানান, চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক বৈঠকে জানানো হয় আগামী ২০ মে গাছ থেকে আম সংগ্রহ করা যাবে। সেই মোতাবেক আগামীকাল বুধবার (২০ মে) থেকে আম নামানো হবে। আম পচনশীল হওয়ায় স্টোর করার সুযোগ নেই। তাই মাসখানেকের মধ্যেই আম বেচাকেনা শেষ হয়ে যায়। চলমান পরিস্থিতি যদি আরও দীর্ঘ হয়, তবে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে। বাগান মালিক আবুল কালাম জানান, রাজশাহী অঞ্চলের পরেই এ অঞ্চলের আম সুস্বাদু ও প্রসিদ্ধ। বিশেষ করে এখানকার হিমসাগর আমের বেশ সুনাম রয়েছে। মালিক জাহাঙ্গীর আলম জানান, এ জেলাতে প্রতি বছর হিমসাগর, ল্যাংড়া, আ¤্রপালি ও মল্লিকাসহ সব ধরনের আমই এ বাগানে উৎপাদন হয়ে থাকে। তিনি আরো বলেন, আমরা চুয়াডাঙ্গা জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চিটাগাং, সিলেটসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন মোকামে আম রপ্তানি করে থাকি। কিন্তু করোনা কারণে আমাদের এই আমগুলো বাজারজাত করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসকের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। চুয়াডাঙ্গা জেলা আম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রেজাউল করিম মুন্সী আম চাষিদের আতংকের কথা স্বীকার করেই তিনি জানান, আমচাষিরা যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হন, এ জন্য এই মুহূর্তে কৃষি বিভাগ ও প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের উদ্যোগ নিতে হবে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আলী হাসান জানান, করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবে আমের বাজার নিয়ে বাগান বা আম ব্যবসায়ীদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আমচাষিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, এ জন্য কৃষি বিভাগ আম বাজারজাত নিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশসনের সাথে বৈঠক করা হয়েছে।
এদিকে, গেলো ১৫ মে থেকে মেহেরপুরে শুরু হয়েছে চাষিদের আম ও লিচু সংগ্রহ। এদিন থেকে গুটি ও বোম্বাই জাতের আম সংগ্রহ করছেন চাষিরা। এছাড়াও ২০ মে থেকে হিমসাগর, ৩১ মে থেকে ল্যাংড়া, ১জুন থেকে গোপালভোগ, ২০ জুন থেকে ফজলি, ১০ জুলাই থেকে মল্লিকা ও আ¤্রপালী, ২৫ জুলাই থেকে বিশ্বনাথ, আশ্বিনা ও বারি-৪ আম সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে এখন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম বরিশাল থেকে আসেননি কোনো পাইকার ব্যবসায়ী। তারপরও সীমিত আকারে চাষিরা নিজেরাই আম ও লিচু ভেঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করছেন। জেলায় দুই হাজার ৬শ হেক্টর জমিতে লিচু ও ২ হাজার ৩শ’ ৫০ হেক্টর জমিতে আমের বাগান রয়েছে।
মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের আমচাষি সাখাওয়াতের অভিযোগ, বাইরের জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এ সময় মেহেরপুরে এসে আম ও লিচু সংগ্রহ করেন। ব্যবসায়ীর পরিমাণ বেশি থাকায় ভালো দামে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারেন চাষিরা। কিন্তু চলতি মরসূমে করোনার প্রভাব পড়েছে আম লিচুতে। ব্যবসায়ীরা না আসায় বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে পারেন তারা। চাষিরা ক্ষতিগ্রস্থ হলে সরকারিভাবে প্রনোদনার দাবি তাদের। ফল ব্যবসায়ী ফারুক জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা তাদের সাথে যোগাযোগ করছেন। আবাসিক হোটেল খোলা না থাকায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারছিনা। সাথে খাবার হোটেলও বন্ধ। ফলে বিপাকে পড়েছে এখানকার ব্যবসায়ীরা। আবার রয়েছে পণ্য পরিবহন সংকট। চালকরা করোনার ভয়ে পণ্য পরিবহন নিয়ে যেতে চাচ্ছেন না। আবার ফিরতি টিপ না থাকায় বেশি ভাড়াও দাবি করছেন।
চাষিদের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কামরুল হাসান মিঞা জানান, বাইরের জেলা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা তাদের সাথে যোগাযোগ করলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের নিরাপত্তা দেয়া হবে। এছাড়াও করোনার প্রভাবে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের তালিকা তৈরি করে প্রনোদনার ব্যবস্থা করছে সরকার। ব্যাংক থেকে ৪ শতাংশ হারে সুদের ব্যবস্থাও করা হবে বলে তিনি জানান।