হঠাৎ করে দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস
গ্যাস সংকটে কমেছে বিদ্যুতের উৎপাদন : নাকাল অবস্থায় সমিতিগুলো
স্টাফ রিপোর্টার: হঠাৎ করে দেশব্যাপী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। রাজধানীসহ দেশের জেলা শহরেও সোমবার এক ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হয়েছে। দুপুরের পর এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে অসহ্য গরমে অনেক এলাকার মানুষ বাসাবাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। শহরের বাইরে গ্রামগুলোতে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার চলছে। কোনো কোনো গ্রামের মানুষ সারাদিনেও এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ পায়নি। এদিন সারা দেশে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিলো। এর বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মতো। সরকারি হিসাবে লোডশিডেং সাড়ে ১২শ মেগাওয়াট বলা হলেও বাস্তবে এটি আড়াই হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে বলে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো সূত্রে জানা গেছে। সোমবার বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে খোদ পিডিবি, ডিপিডিসি, ডেসকো ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীন সমিতিগুলোকে নাকাল অবস্থায় পড়তে হয়েছে। বিকেলের পর বিতরণ কোম্পানিগুলো অনেক এলাকার শপিংমল, দোকানপাট, শিল্প-কলকারখানাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য টেলিফোন করতে বাধ্য হন। কোথাও কোথাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ অবস্থায় ২-৩ দিন ধরে সারা দেশের জনজীবনে নাভিশ্বাস ওঠে।
জানা গেছে, কয়েকদিন ধরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, কোনাবাড়ী, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ এলাকার পোশাকসহ অন্যান্য কারখানায় উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের দিনের অধিকাংশ সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো বিদেশে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রপ্তানি অর্ডার বাতিলের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গ্যাস ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়া নিয়ে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ফেসবুকে নসরুল হামিদ বলেছেন, গ্যাসের স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে। গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে। তিনি বলেন, যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের উচ্চমূল্য ও সরবরাহ সব দেশকেই সমস্যায় ফেলেছে। বিষয়টি বাংলাদেশকেও বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ফেসবু পোস্টে তিনি বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হয়ে সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেন। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানান, তারা দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানান পদক্ষেপ নিয়েছেন। শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাবি আগের তুলনায় গত ২-৩ দিন পিডিবি তাদের গড়ে দুইশ থেকে কোথাও কোথাও ৭-৮শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম দিচ্ছে। যার কারণে তাদের লোডশেডিং করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। পিডিবির দাবি গত ২-৩ দিন ধরে গ্যাস সংকটে তারা সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছেন না। গ্যাসভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত থাকলেও জ্বালানি না থাকায় তারা উৎপাদনে যেতে পারছে না। এ অবস্থায় হঠাৎ এই সংকট তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, এই সংকট আরও ২-৩ দিন থাকতে পারে।
এদিকে গ্যাসের সংকট বেড়ে যাওয়ায় বাসাবাড়ি ও শিল্প-কলকারখানায় ভোগান্তি বেড়েছে। সকাল থেকেই চুলা জ্বলছে না অধিকাংশ বাড়িতে। কলকারখানাগুলোয় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গত ১৫ দিনে গ্যাস সরবরাহ কমেছে ৫০ থেকে ৭৫ কোটি ঘনফুট।
সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ করেছে সরকার। এজন্য দেশে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে আবাসিক শিল্পকারখানাসহ বিদ্যুৎ খাতে। গত জুনের শেষ সপ্তাহে স্পট মার্কেট থেকে যে এলএনজি কেনা হয় ইউনিটপ্রতি (এমএমবিটিইউ) ২৫ ডলারে তা এখন বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪০ ডলার। যার কারণে লোকসান কমাতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। যার কারণে এর চাপ পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
পেট্রোবাংলা বলছে, এক সপ্তাহ ধরে দেশে গ্যাসের সরবরাহ কমেছে দিনে ৩৫ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট। গত ২০ জুন পেট্রোবাংলা দিনে ৩১৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে। এর মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া গেছে ৮৩ কোটি ঘনফুট। ওইদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হয়। তারপরও গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ছিল এক হাজার ২৬৯ মেগাওয়াট। ৩০ জুন পেট্রোবাংলা সরবরাহ করে ২৯৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস, এর মধ্যে এলএনজি থেকে মিলে প্রায় ৬২ কোটি ঘনফুট। রোববার গ্যাস সরবরাহ নেমে আসে ২৮২ কোটি ঘনফুটে। এলএনজি থেকে পাওয়া যায় মাত্র ৪৯ দশমিক ৬ কোটি ঘনফুট। এদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেয়া হয় ৯৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস। গ্যাস সংকটে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়েছে। সরকারি তথ্যমতে সারা দেশে ৮১০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে সারা দেশে। তবে বিতরণ কোম্পানিগুলোর হিসাবে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট।
দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজাহারুল ইসলাম জানান, তারাও বিদ্যুৎ কম পাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তাদের সর্বোচ্চ চাহিদা ৬৪০ মেগাওয়াট। উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলামরকে জানান, তারা ৯০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে গত ১৬ এপ্রিল রাতে। এ সময় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। এর আগের রেকর্ড ছিল ১২ এপ্রিল। ওইদিন ১৪ হাজার ৪২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। গ্রাহকরা বলছেন, এই যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড তারপরও কেন লোডশেডিং? কেন ঢাকার বাইরে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্যাসের স্বল্পতা থাকায় সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে জ্বালানির বিশ্ববাজার এখনো অস্থির। এ অবস্থায় কাক্সিক্ষত পরিমাণ গ্যাস আমদানি করতে পারছে না সরকার। তারপরও শিল্পের সরবরাহ কমিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে।