স্কুলে ভর্তি : কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে অভিভাবকদের হয়রানি
লটারিতে নির্বাচিত দশ সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিলের শঙ্কা : নীতিমালার বাইরে ইচ্ছেমতো কোটা নির্ধারণ
স্টাফ রিপোর্টার: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে লটারি পদ্ধতি প্রবর্তনের পরও অনিয়ম আর হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না অভিভাবকরা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে বাদ দেয়া হচ্ছে লটারিতে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের। এছাড়া কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নিজের মতো করে বিভিন্ন ধরনের কোটা তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের জন্য নির্ধারিত ‘এলাকা কোটা’ বা ক্যাচমেন্ট এরিয়ার অধিকারও ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে। এসব নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সন্তানকে ভর্তি করতে না পেরে অনেকে স্কুলে বিক্ষোভ করছেন। কেউ বা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম অসংখ্য ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেসরকারি স্কুল এবং স্কুল ও কলেজ সংক্রান্ত ২০২২ সালের নীতিমালার ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে মুক্তিযোদ্ধা ৫ শতাংশ, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্য ২ শতাংশ, লিল্লাহ বোডিংয়ের শিশু ১ শতাংশ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২ শতাংশ এবং ক্যাচমেন্ট এরিয়া ৪০ শতাংশ কোটা করা হয়েছে। ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে সহোদর/সহোদরা বা যমজ ভাইবোনের ক্ষেত্রে আগে থেকে একজন পড়লে অপরজনের ভর্তি সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আগে থেকে চালিয়ে আসা ভর্তি বাণিজ্যকারী চক্র নানা ফন্দিফিকির করে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের বাদ দিচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে।
এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান উল্লিখিত কোটার বাইরেও কোটা সৃষ্টি করেছে। এমন ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা পরিচালিত ও দুর্নীতির দায়ে আগে থেকে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান আংশিক এমপিওভুক্ত বা জনবল কাঠামো অনুযায়ী সব শিক্ষকের বেতনভাতা সরকারের কাছ থেকে নিচ্ছে। কিন্তু ভর্তির ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না সরকারের নীতিমালা। এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির মূল ও দুটি শাখা ক্যাম্পাস আছে। গত ১৫ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ফৌজিয়া রাশিদী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, উল্লিখিত নীতিমালা লঙ্ঘন করে মূল ক্যাম্পাসে এলাকা কোটা রাখা হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। আর ‘এজিবি কলোনি কোটা’ রাখা হয়েছে ৪০ শতাংশ। কিন্তু একই প্রতিষ্ঠানের শাখা দুটিতে আবার সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী থানাওয়ারী এলাকা কোটা রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আরেক কেলেঙ্কারি হচ্ছে, মূল ক্যাম্পাসে তারা এলাকা কোটা বলতে কেবল স্থায়ী বাড়িওয়ালাদের বুঝিয়েছে, ভাড়াটিয়া নয়। প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষক ও অভিভাবক জানান, মতিঝিল এলাকায় অনেক কলোনি থাকলেও রহস্যজনক কারণে কেবল তারা এজিবি কলোনির জন্য ৪০ শতাংশ কোটা রাখে। অতীতে ওই কোটায় অবাসিন্দাদের ভর্তি করেছে। গত বছর লটারির বাইরেও দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বলেন, কলোনির নামে কোনো কোটা রাখা হয়নি। এরপর আর কোনো কথা না বলেই ফোন রেখে দেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০-১২ জন অভিভাবক একটি স্কুলের অধ্যক্ষের রুমের সামনে হইচই ও কান্নাকাটি করছেন। একজন নারী বলছিলেন, লটারিতে তার সন্তান টেকার পর তিনি আসেন। কিন্তু স্কুল ভর্তি নিচ্ছে না। আগের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুলে বসেছিলেন। আজও বসে আছেন। কিন্তু ভর্তি নিচ্ছে না। আরেক অভিভাবক বলেন, আগের স্কুল থেকে তিনি বাচ্চার টিসি (ছাড়পত্র) নিয়ে আসছেন। লটারিতে টেকা স্কুলের ড্রেস পর্যন্ত বানাতে দিয়েছেন। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, ভাড়াটিয়া হওয়ায় তারা এলাকা কোটা পাবেন না। আরেক নারী কান্নাভরা কণ্ঠে বলেন, কাগজ যাচাই ছাড়াই তার সন্তানের ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। এ সময় পাশে তার শিশু কন্যাকেও কাঁদতে দেখা যায়। এই চিত্র কেবল বগুড়া নয়, ঢাকাসহ বড় শহরে নামি অনেক স্কুলেই ঘটছে বলে জানা গেছে।
এদিকে শুধু মূল নয়, অপেক্ষমাণ তালিকায় ভর্তির ক্ষেত্রেও অভিভাবকদের হয়রানির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে নীতিমালায় একজন ভাই বা বোন আগে থেকে পড়লে ভর্তি করার কথা আছে। কিন্তু এরপরও কোনো কোনো স্কুল এ ক্ষেত্রে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একই বিষয়ে গত ২১ ডিসেম্বর পুনরায় অফিস আদেশ জারি করতে বাধ্য হয়েছে মাউশি।
এবার সরকারিভাবে অনলাইনে আবেদন নিয়ে সারা দেশে ৫৫০টি সরকারি এবং ২৮৫২টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে নবম শ্রেণিতে শূন্য আসনে ভর্তি কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে সরকারি স্কুলে এক লাখ সাত হাজার ৮৯টি আর বেসরকারি স্কুলে ৯ লাখ ২৫ হাজার ৬৬টি আসন শূন্য আছে। এর মধ্যে সরকারি স্কুলে আসনের চেয়ে প্রার্থী বেশি ছিল। অপরদিকে বেসরকারি স্কুলে প্রার্থী ছিল মাত্র ২ লাখ ৬০ হাজার ৯৩৩ জন। অর্থাৎ ৬ লাখ ৬৪ হাজার ১৩৩ আসনে প্রার্থীই পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ প্রায় ৭২ শতাংশ আসন খালি থাকছে। তবে ভিকারুননিসাসহ শহরাঞ্চলের নামকরা স্কুলে ভর্তির তুমুল প্রতিযোগিতা হয়েছে। মাউশির একজন সহকারী পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, এই সুযোগে মতিঝিল আইডিয়ালের মতো কিছু স্কুলে যাচাই-বাছাইয়ের নামে বাতিল কিংবা মনগড়া কোটা তৈরি করা হয়েছে। ফলে হয়রানির মধ্যে পড়েছেন অভিভাবকরা। প্রতিষ্ঠানটি গত এক দশক ধরে এভাবে ভর্তি-কেলেঙ্কারি করে আসছে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন নিরীক্ষা অধিদপ্তর অনুসন্ধান চালিয়েছে। এর আগের বিভিন্ন প্রতিবেদনেও প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ আছে।
আরেক সহকারী পরিচালক বলেন, সারা দেশে এভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষ বা প্রধান শিক্ষক/অধ্যক্ষরা অন্তত ১০ হাজার আসন শূন্য করে ফেলেছে। তাদের উদ্দেশ্য ভর্তি বাণিজ্য। কেননা, মূল তালিকা শেষ করতে পারলে তারা অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তি নেবে। মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং কমিটির চোখ ফাঁকি দিয়ে সেখানে তারা সরাসরি পদ্ধতিতে দুর্নীতির মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ খুঁজবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাউশি পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক বেলাল হোসাইন বলেন, বিভিন্ন কোটা আর এলাকা কোটার কথা নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এলাকা কোটার সংজ্ঞা ইতঃপূর্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দিয়েছে। সুতরাং এর বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠান গেলে তাকে নীতিমালা লঙ্ঘনকারী হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লটারির মূল তালিকায় নির্বাচিত কতজন শিক্ষার্থীকে এখন পর্যন্ত ভর্তি বাতিল করা হয়েছে সেই তথ্য তাদের কাছে আসেনি। যদিও আবেদন করার ক্ষেত্রে জালিয়াতির আশ্রয় নিলে তা যাচাইয়ের পর বাতিল করার এখতিয়ার স্কুলের আছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান অন্যায়ভাবে বাতিল করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নীতিমালায়ই তাদের শাস্তির বিষয়টি উল্লেখ আছে।