সুদান ফেরতদের মুখে ভয়াবহ বর্ণনা : ভাত ফেলে পাতিলটাও ওরা নিয়ে যায়
সংঘাতকবলিত সুদান থেকে সৌদি আরবের জেদ্দা হয়ে দেশে ফিরেছেন ১৩৬ বাংলাদেশি
স্টাফ রিপোর্টার: আমাদের মারধর করে জিনিসপত্র ও টাকা-পয়সা সব নিয়ে গেছে। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, লুটপাটের দিনে ভাত রান্না করা ছিল। সেই ভাত ফেলে দিয়ে পাতিলটাও ওরা নিয়ে যায়। আমরা চারদিন জিম্মি অবস্থায় ছিলাম। প্রথম দিনেই আমাদের খাবার শেষ হয়ে যায়। পানিও ছিল না পর্যাপ্ত। পেটে ক্ষুধা আর চারপাশে বৃষ্টির মতো গুলির শব্দ। ভয়ে বাচ্চাদের কান্না। কী বীভৎস সময় গেছে ভাবতেই শরীর শিউরে ওঠে। গতকাল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এভাবেই বেঁচে ফেরার বর্ণনা দিচ্ছিলেন সুদান ফেরত মো. সবুজ। লক্ষ্মীপুরের এই প্রবাসী বলেন, আমরা দুই মাস ধরে বেতন পাই না। আমরা নিঃস্ব হয়ে জীবনটা বাঁচিয়ে দেশে ফিরছি। আমার কোরবানি ঈদে দেশে আসার কথা ছিল। এজন্য শপিং করেছি, টাকা জমিয়েছি কিন্তু দেশে আসতে হলো খালি হাতে। সবুজের মতোই জীবন নিয়ে গতকাল দেশে ফিরেছেন ১৩৬ জন প্রবাসী। বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় তাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সেখানে থাকা অন্য বাংলাদেশিদেরও পর্যায়ক্রমে ফিরিয়ে আনা হবে। দেশে ফিরতে পারা প্রবাসীদের চোখে মুখে দেখা গেছে আনন্দের ঝিলিক। অনেকেই কয়েক বছর পর দেশে ফিরেছেন। সঙ্গে আনতে পারেননি কিছুই। এক কাপড়েও এসেছেন অনেকে। গতকাল সকাল ১০টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান সুদান ফেরত ১৩৬ জন প্রবাসী। সবুজ ভয়াবহতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ২৮ রমজান থেকে আমাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে আরএসএফ (আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস)। আমার পিঠে বন্দুক দিয়ে আঘাত করে। আমার সঙ্গে শুধু এই একটা টি-শার্ট ও প্যান্ট আছে। আর কিছ্ইু আনতে পারি নাই। আমাদের রুমে এসে আক্রমণ করতে এসেছিল সেদিন। অনেকভাবে চেষ্টা করছে কিন্তু দরজা খুলতে পারে নাই। পরদিন আনুমানিক পাঁচ হাজার লোক এসে আক্রমণ করে। পুরো পাঁচতলার সব দরজা ভেঙে যা আছে সব নিয়ে যায়। মোট ৪৮টা দরজা ছিল। এমনি অবস্থা যে এই প্যান্টও খুলে নিয়ে যাইতে চাইছিল। অনেক জোর করে প্যান্টটা খুলি নাই। চালের বস্তা, ডালের বস্তা সব নিয়ে গেছে। তারা আমাদের রুমে ঢুকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছিল। আরএসএফ আসার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু দিয়ে দিয়েছি।
আমার কাছে পাঁচশ’ ডলার ছিল, ৫০ হাজার সাদানিজ পাউন্ড ছিল সব দিয়ে দিয়েছি। আমার সঙ্গে থাকা মোবাইলটাও নিয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সব পায় নাই ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা থেকে ছুরি সরায় নাই। তিনি বলেন, খার্তুমে কোনো কোম্পানি নাই সব ধ্বংস হয়ে গেছে।
সবুজ মিয়ার সঙ্গে একই কোম্পানিতে কাজ করতেন আব্দুল কাশেম। তিনি বলেন, আমি টাকা-পয়সা কিছুই নিয়ে আসতে পারি নাই। আমি তিন চারদিন জিম্মি হয়ে ছিলাম। তিনদিন কোনো খাবার পাই নাই। পানি খেয়ে ছিলাম সেটাও পর্যাপ্ত ছিল না।
ছোট্ট দুই ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় পা রেখেছেন আলী শেখ। স্ত্রী সন্তানদের মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। তিনি বলেন, আল্লাহর রহমতে দেশে জীবন নিয়ে আসতে পারছি। ওখানে যারা আছে তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা যখন সৌদি আরব আসার জন্য রওয়ানা দেই, তখনও গাড়ির চারপাশে গুলি করে।
তার স্ত্রী বীথি বলেন, আমার ছোট ছেলেটার বয়স মাত্র তিন বছর। সে কিছুই বোঝে না। গুলির শব্দে ভয়ে কেঁদে ওঠে। ওখানে খাবারের সমস্যা, বিদ্যুৎ নাই। খাবার পানিটাও পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, আমি দুই বছর ধরে সেখানে থাকি, আমার স্বামী ১৭ বছর ধরে সুদানে থাকে।
নাটোর জেলার মো. আজিজুল ইসলাম কাজ করেন ফিলিপস কোম্পানিতে। তিনি বলেন, আমরা ২৮ জন বাঙালি একসঙ্গে ছিলাম। আমি সাড়ে তিন বছর ধরে সুদানে থাকি। প্রায় ২০ থেকে ২২ দিন আমরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটিয়েছে। আমাদের বাড়ির পাশে বিমান দিয়ে বোমা হামলা করা হয়। আল্লাহর রহমতে আমাদের বিল্ডিংয়ের কিছু হয় নাই।
নিশি কান্ত বিশ্বাস বলেন, আমি এখন ঠিক মতো হাঁটতে পারছি না। আমার অপরাধ মোবাইলটা দিতে চাই নাই। আমাদের যখন ডাকাতরা আক্রমণ করে তখন একটা ব্যাগ আগেই গোছানো ছিল সেটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। ব্যাগে মোবাইল, টাকা আর কিছু জামা কাপড় ছিল। আমার ব্যাগ থেকে মোবাইল ও টাকা নিয়ে ব্যাগটা ফেরত দেয়। ব্যাগটা দিতে চাই নাই বলে রাইফেল দিয়ে পায়ে আঘাত করে। এত জোরে মারে যে মনে হচ্ছিল চারিদিকে অন্ধকার আর আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তিনি বলেন, আমার ক্ষতি সবথেকে বেশি। আমি ঋণ করে চার লাখ টাকা দিয়ে এই বছরের জানুয়ারি মাসে সুদানে যাই। এখন মনে হচ্ছে টাকা দিয়ে জেল খেটে আসলাম। মানুষ খুন করে জেল খাটে আমি টাকা দিয়ে জেল খেটে আসলাম।
মাথায় ক্ষত চিহ্ন এখনো স্পষ্ট কাবিল হোসেনের। তিনি বলেন, আমি ২০১৫ সালে সুদান যাই। আমরা একই পাড়ার ১৬জন গিয়েছিলাম। আমরা কার্টন ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। খার্তুমে আমাদের ফ্যাক্টরি ছিল সামরিক ক্যাম্পের পাশাপাশি। ওখানে বেসামরিকরা প্রত্যেকটা সামরিক প্রতিষ্ঠানে হামলা করে। আমাদের ফ্যাক্টরিতেও হামলা করে ঘেরাও করে রাখে। বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ে। আমরা দরজা লাগিয়ে ভেতরে ছিলাম। ওরা বলে তোমরা না নামলে গুলি করবো। এরপর আমাদের চারপাশে গুলি করে। আমরা বের হয়ে আসি বাধ্য হয়ে। ওই সময় ওদের ছোড়া একটা ঢিলে আমার মাথা ফেটে যায়। অনেক খানি ফাটে তারপরও চিকিৎসা নিতে পারি নাই। সেদিন ছিল ঈদের দিন। ওইদিনে আমাদেরকে চার ঘণ্টা অন্ধকার একটা রুমে আটকিয়ে রাখে। এরপর কোম্পানির ফোরম্যান আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমাদের সবাইকে কিছু টাকা আর বাজার করে দিয়ে ওই রুম থেকে বের হতে সাহায্য করে। এরপর থেকে আমরা ঘরছাড়া হই। ওখান থেকে পালিয়ে মসজিদে দুই রাত থাকি। এরপর বাংলাদেশি একজনের পরিবারে আশ্রয় নেই। খালি একটু করে কালাইয়ের ডাল আর চাল দিয়ে বানানো খিচুড়ি খেয়ে সাত দিন পার করি।
কাবিল হোসেনের সঙ্গে ছিলেন মো. শফিকুল ইসলাম, তিনি বলেন, ডাকাতরা আমাদের যখন আক্রমণ করে তখন আমি দুইতলা থেকে লাফ দেই। আমার বাঁ-পা ভেঙে যায়। একটা বাড়িতে সাত দিন আশ্রয় নিয়ে ছিলাম। কোম্পানির মালিক কিছু টাকা আর বাজার করে দিয়েছিল সেটা দিয়ে কালাই আর চাল দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে বেঁচে ছিলাম। আমরা যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করি, সেই ফ্যাক্টরিতেই থাকতাম। যখন ফ্যাক্টরি আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে দেয় তখন আমরা আর থাকতে পারি নাই। খালি একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে চলে আসি। এরপর ফ্যাক্টরির একজন লোক গাড়ি দিয়ে আমাদের কয়েকটা ব্যাগ দিয়ে যায়। সুদানী ২২ হাজার টাকা ছিল ব্যাগে। এই টাকা দিয়ে সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করেছি।
গতকাল দেশে ফেরা প্রবাসীদের স্বাগত জানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। এ সময় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকার জানান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয় করে ধাপে ধাপে অন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।
সুদানে প্রায় ১৫০০ বাংলাদেশি বসবাস করতেন। সংঘাত শুরু হলে তাদের মধ্যে প্রায় ৭০০ জন দেশে ফিরে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রবাসীদের স্বাগত জানিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, আপনারা সবকিছু হারিয়েছেন। দেশে ফিরেছেন কিন্তু ওখান থেকে খালি হাতে এসেছেন। আজকে আমরা যা কিছু দেই না কেন, আইএমও আমাদের সঙ্গে আছে। তাদের সাহায্য ছাড়া এই কাজটা অত তাড়াতাড়ি হতো না। আজকে আইএমও আপনাদের কিছু আর্থিক সাহায্য দেবে। আমরা মন্ত্রণালয়ের কল্যাণ বোর্ড থেকে আপনাদের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য দেবো। সুদান ফেরত প্রবাসীদের দুপুরের খাবার ও পাঁচ হাজার করে টাকা দেয়া হয়। এই অর্থ গ্রহণের পর তারা বিমানবন্দর ছাড়েন। সেখানে পূর্ব থেকে অবস্থান নেয়া অপেক্ষারত স্বজনদের পেয়ে আনন্দে আপ্লুত হন তারা। টঙ্গি থেকে বিমানবন্দরে এসেছিল ছোট্ট হামজা, বয়স চার বছর। এই প্রথম সন্তানকে সামনাসামনি দেখেন মো. আমির। তিনি চার বছর আগে সুদান যান। তার দু’মাস পর জন্ম হয় হামজার। সন্তানকে প্রথমবার দেখে কান্না ধরে রাখতে পারেননি তিনি। তিনি বলেন, নিজের ছেলেকে যে দেখতে পারলাম এজন্য আল¬াহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। একবার তো ভেবেছিলাম ছেলেটা বাবার লাশটাও বুঝি দেখতে পারবে না। সুদানে এই অবস্থায় মারা গেলে লাশটাও দেশে আসতো না হয়তো।