স্টাফ রিপোর্টার: আজ বুধবার রাজনৈতিক পরিম-লে এক অবিস্মরনীয়-অভাবনীয়-অনির্বচনীয় দিন। বাংলাদেশ থেকে ৮ হাজার কিলোমিটার দূরে লন্ডনে সূর্যের ঝলমলে আলোয় উদ্ভাসিত সকালবেলায় এক ঐতিহাসিক মহাপুনর্মিলন ঘটবে শেখ হাসিনার চরম জিঘাংসার শিকার মজলুম মা ও ছেলের। বহু বাধার বিন্দাচল, চড়াই-উত্রাই, অনিশ্চয়তা, শোকগাঁথা-বেদনা-বিষাদ-আনন্দের বহু দগদগে দিনলিপি পেরিয়ে সাড়ে সাত বছর পর বাংলাদেশে যাবতকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাক্ষাৎ হবে। যে অকৃত্রিম মধুরতম সাক্ষাতের জন্য প্রতিটি অনুক্ষণ তারা প্রহর গুনেছেন। পুনর্মিলন ঘটবে বড় পুত্রবধূ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা.জুবাইদা রহমান এবং আদরের নাতনী ব্যারিস্টার জাইমা রহমান, ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর কন্যা জাফিয়া রহমানও জাহিয়া রহমানের সঙ্গে। যে পুনর্মিলনের উদ্বেলিত আবেগ-আনন্দের ঝর্নাধারা ছড়িয়ে যাবে দেশময়। শেখ হাসিনার প্রতিহিংসাপরায়নতা আর অকল্পনীয় জুলুমের শিকার হয়ে গুরুতর অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়া। বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি আওয়ামী ফ্যাসিবাদ এবং প্রতিবেশী দেশের প্রতিহিংসার মূল কারণ তার আপসহীন দেশপ্রেম, তুমুল জনপ্রিয়তা, দেশের সর্বমানুষের প্রাণোৎসাতির ভালোবাসা। যা এই দেশবিরোধী-গণতন্ত্র বিরোধী চক্রের কাছে ছিল অসহনীয়। যে কারণে সর্বজন বিদিত মিথ্যা সাজানো মামলায় তিন বারের সর্ব্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে হাস্যকরভাবে সাজা দিয়ে কারারুদ্ধ করে বছরের পর বছর বিনা চিকিৎসায় চরম অসুস্থ করে তোলা হয়। করোনাকালীন সময়ে তাকে স্যাতস্যেতে কারা প্রকোস্টের বাইরে বাসায় এনে গৃহবন্দী করে রাখা হলেও সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেয়া হয়নি। শেখ হাসিনা কয়েকবার বেগম জিয়াকে প্রাণনাশের আকাংখার কথা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেন। শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে হত্যা এবং রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্দেশে কোনো রকম চিকিৎসার সুযোগ দেয়া থেকে বঞ্চিত রাখার কথাও আকারে ইঙ্গিতে একাধিকবার বলেছেন। বেগম খালেদা জিয়া সর্বশেষ চোখ ও পায়ের ফলোআপ চিকিৎসার জন্য ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে তিনি যাত্রাবিরতি করেন। ১৬ জুলাই বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে খালেদা জিয়া লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সে সময় বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান। লন্ডনে সাক্ষাৎকালে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান উভয়ই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারেক রহমান তখন নিজের গাড়িতে করে মা খালেদা জিয়াকে বাসভবনে নিয়ে যান। সেই ছিল সর্বশেষ জিয়া পরিবারের মিলন। পরে চারটি প্রতিহিংসামূলক মামলা মাথায় নিয়ে লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর। তিনি জানতেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনা তাকে মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করবে। অনিবার্য এই প্রতিহিংসার কথা জেনেই অনেকের অনুরোধ উপেক্ষা করে দেশে আইনের মুখোমুখি হন অসম সাহসী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তার তিন মাসাধিককাল পরেই ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিচারের নামে প্রহসন মঞ্চস্থ করে কারারুদ্ধ করে হাসিনার ক্যাংগারু আদালত। স্বাভাবিকভাবে সুস্থ খালেদা জিয়া হেটে কারাগারে গেলেও নির্যাতন করে তাকে গুরুতর অসুস্থ করে ফেলে হাসিনার দোসররা। বিনা চিকিৎসায় তার শরীরে বাসা বাধে হৃদরোগ, লিভার, ফুসফুস, কিডনি, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায়। কারাগার থেকে যখন তাকে বের করা হয় তখন তিনি হুইল চেয়ারে। শহীদ রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে শাহাদত বরণের পর দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে আগলে রেখেই দিন কাটে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। গৃহবধূ থেকে রাজনীতির মাঠে এসে তিন বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ চালিয়েছেন তিনি। দেশকে পরিণত করেছিলেন ইমার্জিং টাইগারে। তবে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে কলংকিত এক এগারোর সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে বিনাশের নীলনক্সা বাস্তবায়নে জিয়া পরিবারকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়া হয়। দুই ছেলের একজন বিদেশে থাকতেই মারা যান। বড় ছেলে তারেক রহমানকে জেলে বন্দী করে হত্যার উদ্দেশে ভয়াবহভাবে নির্যাতন করা হয়। পঙ্গু করা হয় তাকে।
২০০৭ সাল থেকে পরিবারসহ চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছেন লন্ডনে। সেখান থেকেই বিএনপিকে তারেক রহমান তৃণমূল শক্তিতে পরিনত করেন। তিনি জনগণের আইকনে পরিণত হয়েছেন। লম্বা বিরতির পর ২০১৭ সালে একবার মা-ছেলের সঙ্গে দেখা হলেও গত সাড়ে সাত বছর কেটেছে ভার্চুয়াল কথাবার্তার মধ্যদিয়ে। আজ হবে সরাসরি সাক্ষাৎ। আজ এক আবেগঘন সময়ের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশের মানুষের দুই জিয়নকাঠি। আজ ৮ জানুয়ারি, বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টায় খালেদা জিয়ার বহনকারী এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশটিতে পৌঁছার পর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাকে বরণ করে নেবেন তারেক রহমান। জিয়া পরিবারকে আবার দেখা যাবে এক ফ্রেমে।
এদিকে গতকাল রাতে লাখো মানুষের ফুলেল শুভেচ্ছার মধ্যে লন্ডন যাত্রা কালে বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া কামনা করেছেন।
এদিকে বেগম খালেদা জিয়ার এখন বয়স ৭৯ বছর। ছয় বছর আগে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা তাকে বানোয়াট মামলায় ফরমায়েশী রায়ে কারাবন্দী করে। সেই থেকে পুরান ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারেই দুই বছর বন্দীদশায় ছিলেন। এই সময়ে কারাগারে একাধিকবার গুরুতর অসুস্থও হন খালেদা জিয়া। তার শরীরে বাসা বাধে দুরারোগ্য ব্যাধি। অবশ্য খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে সবধরনের কর্মসূচি বিএনপি পালন করেছে। সভা-সমাবেশ, মিছল, গণঅনশন, দোয়া মাহফিল থেকে শুরু করে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, কালো পতাকা মিছিল, স্মারকলিপি প্রদান, কূটনীতিকদের কাছে আবেদনসহ বহুমুখী তৎপরতা চালানো হয়েছে। বিশেষ করে আন্দোলনের পাশাপশি খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষেও তৎকালীন আওয়ামী সরকারের কাছে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য অসংখ্যবার আবেদন করা হয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই মন গলেনি শেখ হাসিনা ও তার সরকারের। অনুমতি দেয়ার নামে বারবার আবেদন প্রত্যাখ্যান ও কালক্ষেপণ করা হয়। এমনকি বিগত সরকারের তরফে তাচ্ছিল্য করে বার বার হাসিনা ও তার ফ্যাসিবাদের দোসররা বার বার বলেছে, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) সুস্থ আছেন’। বিএনপি তাকে নিয়ে নাটক করছে।’ যা নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটে। দীর্ঘ এই সময়ে মাঝে মধ্যেই রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন খালেদা জিয়া। বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে শরীরে বিশেষ অস্ত্রোপচারও করা হয়। সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে পরদিন ৬ আগস্ট কারামুক্ত হন দেশের জনগনের প্রানপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়া। গতকাল রাতে কাতারের আমিরের রাজকীয় বিমানে (এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স) উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন বিএনপির চেয়ারপারসন। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার খবর জেনে রাজকীয় বহরের এই বিশেষ বিমান পাঠান। ওই বিমানে সর্বাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা সম্বলিত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে রয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, লন্ডনে নেমেই সরাসরি লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হবেন খালেদা জিয়া। এরপর তিনি বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসায় যাবেন। প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শে লিভারের উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার পথে ওমরাহ পালনও করার কথা রয়েছে। গতকাল মঙ্গলাবার রাতে দেশ ছাড়ার আগে লাখো নেতাকর্মীর ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি। পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কড়া নিরাপত্তার পাশাপাশি কয়েক হাজার দলীয় নেতাকর্মী খালেদা জিয়ার গাড়িবহরকে গুলশানের বাসা থেকে এস্কর্ট দিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়। তার আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ অঙ্গ সংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী দলীয় প্রধানের বাসার সামনে সমবেত হন। মূলত খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা ও এর দিন-তারিখ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা চলছিল। একাধিকবার তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। খালেদা জিয়াসহ সফরসঙ্গীদের কারও কারও ভিসা-সংক্রান্ত জটিলতাও ছিল। শেষে ৭ জানুয়ারি বিদেশ যাত্রার দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয় এবং সে অনুযায়ী সব প্রস্তুতি নেয়া হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরবের ভিসা নিয়েছেন। জানা যায়, ২০২১ সালের নভেম্বরে খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন চিকিৎসকরা। তার পরিবার ও দলের পক্ষ থেকেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বারবার আবেদন-নিবেদন জানানো হয়। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার প্রতিবারই তা উপেক্ষা করেছে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ এক নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে তাকে শর্ত সাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছিল। এমন অবস্থায় ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের নির্দেশে খালেদা জিয়া স্থায়ী মুক্তি পান। এভারকেয়ার হাসপাতালে থেকে ওই সুসংবাদ পান তিনি। তখন এক মাস ১২ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর গতবছরের ২১ আগস্ট বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে তার চিকিৎসা বাসায় চলছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নিতেও বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হয়।
এদিকে লন্ডন যাত্রার সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার মধ্যেই গত রোববার রাতে গুলশানে তার বাসা ‘ফিরোজা’য় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করেন খালেদা জিয়া। সেদিন‘ফিরোজা’ থেকে বেরিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের আপোসহীন নেত্রী….তিনি চিকিৎসার জন্যে ৭ জানুয়ারি রাতে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। সেজন্য আমরা জাতীয় স্থায়ী কমিটির সকল সদস্য উনার কাছে এসেছিলাম শুভেচ্ছা জানাতে। আমরা তার সঙ্গে আলাপ করেছি, কথা বলেছি। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে এই দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ করে আবার আমাদের মাঝে, দেশের মানুষের মাঝে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং গণতন্ত্রের জন্য আমাদের যে সংগ্রাম চলছে সেই সংগ্রামে তিনি যেন নেতৃত্ব দিয়ে সেই সংগ্রামকে সফল করতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষেরও সেই প্রত্যাশা।
পূর্ববর্তী পোস্ট
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.