স্টাফ রিপোর্টার: সম্পত্তির হিসাব না দেয়ার জন্য কোনো অজুহাতই দাঁড় করাতে পারবেন না সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রতিবছর আয়কর বিবরণী জমা দিলেও সরকারের নির্ধারিত দপ্তরে সম্পদের হিসাব দেয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালের আচরণ বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ‘সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-২০২২’ এর খসড়া প্রায় চ‚ড়ান্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারি চাকারি আইনের অধীনে এই বিধিমালাটি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সম্পদের হিসাব দেয়ার বিষয়টি আইনি রূপ পাচ্ছে। আইনগত বাধ্যবাধকতাও তৈরি হবে। এটি শিগগিরই অনুমোদনের জন্য প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে।
বিদ্যমান বিধিমালায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সম্পদের হিসাব দেয়ার বিধান থাকলেও আয়কর বিবরণীর বিষয়টি উল্লেখ নেই। ফলে যারা আয়কর বিবরণী জমা দেন, তারা এটিকে অজুহাত হিসাবে দেখিয়ে সম্পদের হিসাব জমা দেয়া থেকে বিরত থাকেন। এমনকি একাধিকবার নির্দেশনা দেয়ার পরও সম্পদের হিসাব দেননি সিংহভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী।
‘সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-২০২২’-এর খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, এনবিআরে সম্পদের হিসাব দিলেও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে পৃথকভাবে সেই হিসাব জানাতে হবে। এই ক্ষেত্রে সরকারের নির্ধারিত ছক পূরণ করতে হবে। সেটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দিতে হবে। অথবা আয়করের বিবরণী জমা দিলেও চলবে, যদি এর বাইরে অন্য কোনো সম্পদ না থাকে। জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালাটি যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিগগিরই বিধিমালার খসড়া সচিব কমিটিতে পাঠানো হবে। আশা করি, সংশোধিত বিধিমালাটি সব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শৃক্সখলা বিধানে আরও কার্যকর ভ‚মিকা রাখবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালাটি ৪৩ বছরের পুরোনো দলিল হলেও এর আওতায় সম্পদের হিসাব প্রায় কেউই দেন না। সরকারের পক্ষ থেকেও এই বিষয়ে কড়াকড়ি দেখানো হয় না। এই সুযোগ দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে স¤প্রতি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক দফায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সম্পত্তির হিসাব দিতে তাগিদ দেয়া হলেও প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যায়নি। বিধিমালার কিছু দুর্বলতার কারণে সম্পদের হিসাব ঠিকমতো নেওয়ার বিষয়ে সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, বিধিমালা সংশোধনের মাধ্যমে নতুন কিছু বিষয় সংযোজন করা হচ্ছে। সম্পদের হিসাব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারসহ প্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রস্তাব করা হচ্ছে। বিধিমালাটি সংশোধন হলে এ সংক্রান্ত বিষয়গুলোয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনেক বিষয়ে স্পষ্ট ধারাণা পাবেন আশা করি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে পাওয়া তথ্যে, ২০১৩ সালে বিধিমালাটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হলেও চার বছর পর ২০১৮ সালে সেই সংশোধনের প্রায় চ‚ড়ান্ত উদ্যোগ থেমে যায়। তখন সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন হওয়ায় এ আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিধিমালা সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও চলে গেছে আরও চার বছর। সময় উপযোগী করতে বিধিমালায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্পর্কে নতুন কিছু নিয়মকানুন ঢুকানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন করার বিষয়েও কিছুট লাগাম টানা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিদ্যমান বিধিমালায় প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে ঢোকার সময় সম্পদের হিসাব দিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি সরকারকে জানাতে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বছরের কোন সময়, কী পদ্ধতিতে হিসাব দিতে হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। প্রস্তাবিত সংশোধনে পাঁচ বছর পর ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব সরকার নির্ধারিত ছকে দিতে হবে। যারা আয়করের তথ্য দাখিল করবেন তাদের আয়কর সনদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাখিল করতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ কোন দপ্তর হবে তা সরকার গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে জানিয়ে দেবে।
বিদ্যমান বিধিমালায় কোম্পানি স্থাপন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের বারণ আছে। প্রস্তাবিত সংশোধনে এটা বহাল থাকলেও সরকারের অনুমতিক্রমে নিবন্ধনকৃত সমবায় সমিতি স্থাপন ও ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতে পারবে কর্মচারীরা। এছাড়া ১৭-২০ গ্রেডের কর্মচারীরা সরকারি কাজের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন। তবে অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবসা করতে গেলে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। একইসঙ্গে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তার এখতিয়ারাধীন এলাকায় নিজ পরিবারের সদস্যকে সরকারের অনুমোদন না নিয়ে ব্যবসায় জড়াতে পারবে না।
সরকারি দলিলাদি বা তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কঠোর ধারাই বহাল রাখা হচ্ছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বা সাংবাদিকদের কারও কাছেই তথ্য দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইনের আওতাধীন তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা না থাকার বিষয়টি নতুন যুক্ত করা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত সংশোধনে গণমাধ্যমের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো প্রচারে অংশ নিতে সরকারি অনুমোদনের কথা বলা হয়েছে। তবে সরকারের উন্নয়নকাজ সম্পর্কিত বিষয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কথা বললে তা ইতিবাচক হিসাবে দেখা হবে।
বিধিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো কমিটিতে সাক্ষ্য দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এখন অনুমোদন নিতে হয়। নতুন সংশোধনে এর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে যে, সাক্ষ্য দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নীতি বা সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা যাবে না। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না। কেউ যদি কোনো নির্বাচনে নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান তাহলে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, এমন অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে পারবে সরকার। নারী সহকর্মীদের প্রতি অসঙ্গত আচরণ ও শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। ‘অসঙ্গত আচরণ’ বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলে সরকারকে জানাতে হবে। বিদ্যমান বিধিমালায় এটি নেই।
রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর বিষয়ে বিদ্যমান বিধিমালাতেও বারণ রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনে এটা বহাল রেখে একমাত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনের সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো আন্দোলন করতে পারবে না, একইসঙ্গে আন্দোলন করতে কাউকে উৎসাহিত বা নির্দেশও দেয়া যাবে না।
‘সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-১৯৭৯’ প্রণয়নের পর ১৯৮৫ সালে প্রণীত ‘সরকারি কর্মচারী (শৃক্সখলা ও আপিল) বিধিমালার অধীনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হতো। ২০১৮ সালে সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ণের পর ৮৫ সালের বিধিমালা বাতিল হয়ে যায়। এরপর আইনের অধীনে ‘সরকারি কর্মচারী (শৃক্সখলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮’ প্রণয়ন করে সরকার। প্রস্তাবিত সংশোধন পাস হলে এ বিধিমালার অধীনেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার।