সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী নিয়ে কৌশলী বিএনপি
প্রকাশ্যে টানাপোড়েন পর্দার আড়ালে যোগাযোগ : একদফা আন্দোলনে একমত
স্টাফ রিপোর্টার: জামায়াতে ইসলামী নিয়ে ‘কৌশলী’ ভূমিকায় বিএনপি। দুই যুগের বেশি সময়ের মিত্র দলটির (জামায়াত) সঙ্গে প্রকাশ্যে টানাপোড়েন দেখা গেলেও পর্দার আড়ালে নতুন করে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপির দুই সিনিয়র নেতার সঙ্গে জামায়াতের একাধিক নেতার আলাপ হয়। সেই আলোচনায় উভয় দলের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব কমানোর বিষয়টি স্থান পায়। একই সঙ্গে দুদল সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে নামার বিষয়েও একমত পোষণ করে। এজন্য সামনে পৃথক কর্মসূচি দিয়ে তারা মাঠে থাকবে। বিএনপি ও জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সূত্রমতে, রাজনৈতিক নানা হিসাবনিকাশ বা কৌশল থেকে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের অনেকে মনে করেন, পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিএনপি ও জামায়াতের জোটবদ্ধ আন্দোলন এবং নির্বাচন নিষ্ফল হয়েছে। উপরন্তু সরকারি দলের বিরূপ প্রচারে ‘বিএনপি-জামায়াত’ জোট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। এর দায় পড়ছে বিএনপির ওপর। এই পরিস্থিতি এড়াতেই জামায়াতকে একটু দূরে রেখে অন্য মিত্রদের নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে বিএনপি। তবে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি আবার যোগাযোগ করেছে। সম্প্রতি বিএনপির দুই সিনিয়র দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে জামায়াতের দুই নেতার এ যোগাযোগ হয়। এতে জামায়াত নেতারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। চূড়ান্ত আন্দোলনে জামায়াত পৃথকভাবে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে রাজপথে থাকবে বলেও নেতারা বিএনপিকে জানান।
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দল যার যার অবস্থান থেকে কাজ করছে। বিএনপির সঙ্গেও এখন আমাদের আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এভাবে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকলে দাবিগুলো একপর্যায়ে গিয়ে একদফার হবে। আর একদফা দাবি আদায়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের বিষয়ে আমরা সবাই একমত। যুগপৎ আন্দোলন না ভিন্ন কিছু, তা সময় হলেই দেখা যাবে।’
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’ এ নিয়ে দলটির আরও দুজন স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা হয়। তারা এ ব্যাপারে উদ্ধৃতি দিতে রাজি হননি। তবে বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এমন নয়। জামায়াতের আমির গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত একটা যোগাযোগ ছিলো। পরে যোগাযোগ ছিলো না। সাংগঠনিক ভিত্তির কারণে এখন জামায়াতকে আবারও মূল্যায়ন করার বিষয়টি সামনে আনছেন কেউ কেউ। বিএনপি জামায়াতকে ডাকেনি। বরং জামায়াতের অনুরোধে বিএনপি সাক্ষাৎ দিয়েছে।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের বিষয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কোনো কোনো প্রভাবশালী নেতা মনে করেন, এখন আর বিএনপির সামনে জামায়াতকে প্রকাশ্যে আনার সুযোগ নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘জামায়াতকে আর বিএনপির সঙ্গে দরকার নেই। বিএনপি ইতোমধ্যে রাজপথে একক শক্তি প্রদর্শন করে প্রমাণ করেছে-একলা চলো নীতির ফলে দলের রাজনীতি পরিষ্কার হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়েছে। অনেক কর্মীও মনে করত, জামায়াত না থাকলে বিএনপি পারবে না। কিন্তু বিগত এক বছরে তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।’
জানা যায়, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়। এর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে ২৪ ও ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলে অংশ নেয় জামায়াত। তবে ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিল করতে গিয়ে মালিবাগে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও লাঠিপেটার শিকার হন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এতে অনেকে আহত হন, অনেকে গ্রেফতার হন। পরে দলের আমিরকেও গ্রেফতার করা হয়। এসব ঘটনায় বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কার্যত এরপর থেকেই বিএনপির ওপর ‘ক্ষোভ’ ও ‘অভিমান’ করে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলোয় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। তবে নিজস্ব কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপির আগে বা পরে মাঠে তৎপর রয়েছে জামায়াত। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পর আরও সক্রিয় হয়েছে দলটি। সূত্রমতে, সোমবার রাজধানীতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ছিলো জামায়াতের। এ নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতিও নেয় দলটি। কিন্তু পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় তা স্থগিত করা হয়। শনিবার রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে দুপুর ২টায় ফের বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের নতুন কর্মসূচি দিয়েছে জামায়াত। মূলত শান্তিপূর্ণভাবে এ কর্মসূচি পালন করতে চায় দলটি। এর মাধ্যমে বিশাল শোডাউন করে নিজেদের শক্তি জানান দিতে চাইছে তারা।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন বেপারি বলেন, ‘অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কৌশলগত কারণে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছে বিএনপি। দূরত্ব থাকলেও ধীরে ধীরে ঘুচে যাবে মনে হয়।’ তিনি বলেন, শুরুর দিকে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন করেছে। তাদের অনেক নেতাকর্মী আহত ও গ্রেফতার হয়েছেন; কিন্তু এ নিয়ে বিএনপি কোনো বিবৃতি বা বক্তব্য দেয়নি। যে কারণে জামায়াত ক্ষুব্ধ। বহির্বিশ্বও মনে করছে, বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, জামায়াতকে রাজপথে নামতে হবে। কারণ, তার অস্তিত্বের প্রশ্ন আছে। সংগঠনকে বিকশিত করতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এ সুযোগটা তারা গ্রহণ করবে। বিএনপি যদি দূরত্ব রাখতে চায়, তারপরও জামায়াত আন্দোলনে আসবে। তারা হয়তো যুগপৎ স্বীকার করবে না; কিন্তু যুগপতের মতোই আন্দোলন শুরু করবে। আর যেসব রাজনৈতিক দল এখন রাজপথে আছে, তাদের ছাড়াও সামনে হয়তোবা অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোও আন্দোলনে যোগ দিতে পারে।