সম্পূরক কাগজপত্র জমা দিতে ৭৭টি দলকে চিঠি দেবে ইসি : বাসদসহ বাদ পড়েছে ১৪টি দল
নিবন্ধনে প্রাথমিক বাছাই সম্পন্ন : টিকলো জামায়াত সমর্থিত বিডিপি ও নুরুর গণঅধিকার পরিষদ
স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে গেছে জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ (বিডিপি) ও ‘এ বি পার্টি’ (আমার বাংলাদেশ পার্টি)। এ দুটিসহ মোট ৭৭টি রাজনৈতিক দল প্রথম বাছাইয়ে টিকেছে। এ তালিকায় ড. রেজা কিবরিয়া ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন ‘গণঅধিকার পরিষদ’ এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যও রয়েছে। এসব দলকে সম্পূরক বা যেসব কাগজপত্রের ঘাটতি রয়েছে তা জমা দিতে সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি দিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে প্রাথমিক বাছাইয়ে বাদ পড়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদসহ ১৪টি রাজনৈতিক দল। এর বাইরে আরও দুটি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেও তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন রাজনৈতিক দলের আবেদন যাচাই-বাছাই করে ইসি সচিবালয় একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদন কমিশনে উপস্থাপনও করেছে।
রাজনৈতিক দলের আবেদন যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, প্রাথমিক বাছাইয়ে ৭৭টি দল টিকেছে। ১৪টি দলের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। দুটি দল তাদের আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত পেলে ওইসব দলকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে। বিডিপি ও এবি পার্টির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৭৭টি দল প্রাথমিকভাবে টিকেছে। সব দলের নাম মনে নেই।
প্রসঙ্গত, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে ইসির নিবন্ধিত হতে হয়। এবার ৯৩টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। বর্তমানে ইসিতে ৩৯টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত রয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে নতুন দলের নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির রোডম্যাপে।
জানা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। এর পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। নিবন্ধন বাতিলের পর ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। এবার ভিন্ন নামে নিবন্ধন পেতে জামায়াত নেতারা একাধিক দলের আবেদন করেছে। যদিও সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলে যদি যুদ্ধাপরাধী না থাকে এবং তাদের গঠনতন্ত্র যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলে শর্ত পূরণ করে ভিন্ন নামে তাদের নিবন্ধন পেতে বাধা নেই।
ইসি সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ৯৩টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে ইসিতে আবেদন করে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ১৪ জন কর্মকর্তা ওইসব আবেদন যাচাই-বাছাই করেন। সম্প্রতি ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথের সভাপতিত্বে নতুন দল নিবন্ধন সংক্রান্ত কমিটি কয়েক দফায় বৈঠক করে। ওই বৈঠকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৮-এ উল্লিখিত শর্ত পূরণের সপক্ষে কাগজপত্র জমা দিয়েছে তা বাছাই করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ওই প্রতিবেদনে ১৪টি দলের আবেদন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। ৭৭টি দলের যেসব কাগজপত্রের ঘাটতি রয়েছে তা পূরণে সময় দিয়ে চিঠি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ওই প্রস্তাব অনুমোদনও করেছে নির্বাচন কমিশন। এখন দলগুলোকে চিঠি দিয়ে যেসব কাগজপত্রের ঘাটতি রয়েছে তা জমা দিতে ১৫ দিনের সময় দেওয়া হবে। প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে যাওয়া এ তালিকায় জামায়াত সমর্থিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) ও এ বি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি)ও রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, বিডিপি তাদের নিবন্ধন আবেদনের সঙ্গে ২৫ হাজার ১৩৬ পৃষ্ঠা কাগজপত্র জমা দিয়েছে। আর এ বি পার্টি জমা দিয়েছে ৮ হাজার ৫৪ পৃষ্ঠা। তবে এ দুটি দলের আবেদনের বেশ কিছু ঘাটতি রয়েছে। বিডিপির গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু বিষয় অস্পষ্ট রয়েছে; যা আরপিওর ধারা ৯০(খ) এর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ৯০(খ) ধারায় বলা আছে, দলের গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয়সহ সব পর্যায়ে কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা; সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখা লক্ষ্য নির্ধারণ; শিক্ষক-ছাত্র, আর্থিক, বাণিজ্যিক বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বা শ্রমিকদের নিয়ে সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠন না থাকার বিষয়টি দলীয় গঠনতন্ত্রে উল্লেখ থাকতে হবে। নইলে ওই দলটি নিবন্ধনের যোগ্য হবে না। এ বি পার্টির উপজেলা পর্যায়ের কমিটির যেসব তালিকা জমা দিয়েছে; সেখানে অনেক উপজেলায় ২০০ ভোটারের স্বাক্ষর নেই। এছাড়া বেশ কিছু ঘাটতি রয়েছে। একই অবস্থা গণঅধিকার পরিষদের। এ দলটি তাদের আবেদনের সঙ্গে ৪৭ হাজার ৯৭১ পৃষ্ঠা কাগজপত্র জমা দিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, প্রাথমিকভাবে টিকে যাওয়া দলগুলোর কাগজপত্র পাওয়ার পর সেগুলোর কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের কার্যালয় ও কার্যক্রম আছে কিনা-তা খতিয়ে দেখবে নির্বাচন কমিশন। কারণ নিবন্ধন পেতে হলে তিনটি শর্তের মধ্যে অন্তত একটি পূরণ করতে হবে। শর্ত তিনটি হলো-১. বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে অনুষ্ঠিত যে কোনো সংসদ নির্বাচনের যে কোনো একটিতে দলীয় নির্বাচনি প্রতীকে একটি আসন পেতে হবে। ২. কোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনি এলাকায় মোট প্রদত্ত ভোটের অন্তত ৫ শতাংশ ভোট প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। ৩. দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলায় ও অন্তত ১০০টি উপজেলায় বা মেট্রোপলিটন থানায় কার্যালয় থাকতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় দলের সদস্য হিসাবে ন্যূনতম ২০০ ভোটার তালিকাভুক্ত থাকতে হবে। বিডিপি, এ বি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ তৃতীয় শর্ত পূরণ করেছে বলে তাদের আবেদনে উল্লেখ করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিক বাছাইয়ে ৭৭টি দল থাকলেও মাঠ যাচাইয়ে বেশিরভাগ দলই টিকবে না। কারণ হিসাবে তারা বলেন, কাগজ-কলমে কার্যালয় থাকলেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব আছে কিনা-তা সন্দিহান। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে যে ২০০ জন স্বাক্ষর করেছেন তা সঠিক কিনা-সেটাও দেখার বিষয়।
ইসির প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে থাকা বাকি দলগুলো হচ্ছে-নৈতিক সমাজ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল রিপাবলিকান পার্টি, নতুন বাংলা, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি), বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোট (পিডিএ), বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ আম জনতা পার্টি ও বাংলাদেশ তৃণমূলজনতা পার্টি (বাংলাদেশ টিজেপি)। আরও রয়েছে-সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম, বাংলাদেশ এলডিপি, বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল গ্রিন পার্টি, বাংলাদেশ সর্বজনীন দল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, গণরাজনৈতিক জোট-গর্জো, বাংলাদেশ বেকার সমাজ, বাংলাদেশ হিন্দু লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলামী পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় দল, জাতীয় জনতা পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি), বাংলাদেশ তৃণমূল লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএনডিপি), ভাসানী অনুসারী পরিষদ, নাকফুল বাংলাদেশ, মুক্ত রাজনৈতিক আন্দোলন এবং বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি। তালিকায় আছে-বাংলাদেশ তৃণমূল কংগ্রেস, বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট পার্টি-বিএইচপি, যুব স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ন্যাপ (ভাসানী), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ ইসলামিক গণতান্ত্রিক লীগ, বাংলাদেশ মাইনরিটি পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গ লীগ, নাগরিক ঐক্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বাংলাদেশ সনাতন পার্টি, বাংলাদেশ জনতা পার্টি (বিজেপি), জনতার অধিকার পার্টি (পিআরপি), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জনস্বার্থে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় ইনফাস পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), বাংলাদেশ মানবতাবাদী দল, বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট গ্রিন পার্টি, বাংলাদেশ গণআজাদী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড, গণঅধিকার পার্টি, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি-বিপিপি, বাংলাদেশ গরিব পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন, বাংলাদেশ জনতা পার্টি, বাংলাদেশ শ্রমজীবী পার্টি, বাংলাদেশ সৎ সংগ্রামী ভোটার পার্টি, ফরওয়ার্ড পার্টি, ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী গ্রুপ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাজাহান সিরাজ), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ (বিজেএল), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি এবং বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি)।
১৪টি দলের আবেদন বাতিল: আবেদনপত্রের সঙ্গে ট্রেজারি চালান, দলীয় গঠনতন্ত্রসহ মৌলিক কাগজপত্র জমা না দেওয়ায় ১৪টি দলের আবেদন বাতিল করেছে কমিটি। দলগুলো হচ্ছে-মুসকিল লীগ, বঙ্গবন্ধু দুস্থ ও প্রতিবন্ধী উন্নয়ন পরিষদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলন (বিজিএমএ), বৈরাবরী পার্টি, বাংলাদেশ বিদেশ প্রত্যাগত প্রবাসী ও ননপ্রবাসী কল্যাণ দল, বাংলাদেশ জনমত পার্টি, বাংলাদেশে ডেমোক্রেসি মুভমেন্ট (বিডিএম), নতুন ধারা বাংলাদেশ-এনডিবি, মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিজম ডেমোক্রেটিক পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী ন্যাপ), সাধারণ জনতা পার্টি (জিপিপি), জাতীয় ইসলামী মহাজোট, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এবং স্বদেশ কল্যাণ কর্মসূচি।
দুই দলের আবেদন প্রত্যাহার : নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে দুটি দল তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা কল্যাণ পরিষদ।