সব ষড়যন্ত্র ও বাধা জয় করে আওয়ামী লীগ অবশ্যই এগিয়ে যাবে

আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, সব বাধা, ষড়যন্ত্র ও আঘাত মোকাবেলা করে দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবে। তারা ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, সে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। গতকাল শনিবার আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সম্মেলন শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে খালেদা জিয়া ভোট চুরি করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিল। কিন্তু কারও ভোট চুরি করলে বাংলাদেশের মানুষ তা মেনে নেয় না। ভোট চোরদের জনগণ ছেড়ে দেয় না। বিএনপিকেও ছাড়েনি। তখন গণঅভ্যুত্থান ও আন্দোলন হয়েছিল। জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছে। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে হাত দেয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আর পিছিয়ে যাবে না, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আমরা জাতির পিতার স্বপ্নপূরণ করবো, ইনশাআল্লাহ। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে শেষ হয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন। এরপর বিকেল ৩টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় (কাউন্সিল) অধিবেশন। এই অধিবেশনে শেখ হাসিনা আবার দলের সভাপতি এবং ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের শুরুতে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন শেখ হাসিনা। দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। পরে শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর পরপরই কাউন্সিলের থিম সং পরিবেশন করা হয়। উদ্বোধনী পর্বে শোকপ্রস্তাব উপস্থাপন করেন দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। এরপর সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ওবায়দুল কাদের। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শেখ হাসিনা বক্তৃতা শুরু করেন। তিনি প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ভাষণ দেন। এবারের জাতীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সেøাগান হচ্ছে-‘উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়।’ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য ও অভ্যর্থনা কমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম স্বাগত বক্তৃতা করেন। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এবং উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার উদ্বোধন শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এ পর্ব সঞ্চালনা করেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস। সম্মেলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটের শরিক দলের নেতারা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও সাধারণ সম্পাদক মুজিবুল হক (চুন্নু), ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন, জাতীয় পার্টি-জেপির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলাম, ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তবে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আসেননি। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীও আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে এসেছিলেন। এবারের সম্মেলনে সারা দেশ থেকে প্রায় ২১ হাজার কাউন্সিলর ও প্রতিনিধি অংশ নেন। আমন্ত্রিত অতিথি মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের খাবারের আয়োজন করা হয়। ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধিরা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান আয়োজনের কারণে এবার অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

অনেকটা পদ্মা সেতুর ওপরে নৌকার আদলে এবারের সম্মেলনের মঞ্চ করা হয়। মূল মঞ্চের দৈর্ঘ্য ৮০ ফুট, প্রস্থ ৪৪ ফুট এবং উচ্চতা ৭ ফুট। এছাড়া কাউন্সিলস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেশ কয়েকটি এলইডি মনিটরও স্থাপন করা হয়। সারা দেশ থেকে আগত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরা এই মনিটরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। দলের নির্বাচনি প্রতীক নৌকা বানিয়ে সম্মেলনে আসেন অনেক কর্মী-সমর্থক। শেখ হাসিনা বলেন, ভোট দেওয়ার যে অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, সেই অধিকার আওয়ামী লীগই নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশে নির্বাচন কী ছিল-এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, নির্বাচন মানেই ছিল, আমরা যেটি বলতাম ১০টা হোন্ডা, ১০টি গুন্ডা, নির্বাচন ঠান্ডা। এই নির্বাচনি সংস্কার, এটিও কিন্তু আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল, মহাজোট মিলে আমরা একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর যে কাজই করুক, আমাদের জেল খাটাক, কিন্তু তারা সেই প্রস্তাবের কিছু কাজ বাস্তবায়ন করে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জানি ভোটকে অনেকেই ‘কন্ট্রোভার্সিয়াল’ করতে চায়। অনেকে অনেক কথা বলে। আমরা নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন করে দিয়েছি। সেই আইন মোতাবেকই রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি করে নির্বাচন কমিশন গঠন করছেন। সেখানে আওয়ামী লীগ কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিয়েছি। আগে নির্বাচন কমিশনের আর্থিক সক্ষমতা নিজস্ব ছিল না, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে রাখা ছিল। আমরা সেটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে নির্বাচন কমিশনের হাতে দিয়েছি। বাজেট থেকে সরাসরি তাদের টাকা দেওয়া হয়, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করেছি। ভোটার আইডি কার্ড করে দিয়েছি, ইভিএম কিছু কিছু চালু হয়েছে। সেখানে কিন্তু কারচুপি করার কোনো সুযোগ আছে বলে আমরা জানি না। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের যদি জনগণের ভোট চুরির দুরভিসন্ধি থাকত, তাহলে আমরা এতকিছু কেন করব? খালেদা জিয়ার মতো ওই আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন করতাম, তা তো আমরা করিনি। আমাদের জনগণের ওপর আস্থা আছে, বিশ্বাস আছে। আমরা সেই বিশ্বাস নিয়েই চলি।

বঙ্গবন্ধুর সন্তান দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা আয় করতে ক্ষমতায় আসেনি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে তার এবং তার সরকারের ওপর দুর্নীতির অভিযোগ এসেছিল। তিনি সেই অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে মোকাবেলা করেন, যা পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়। তিনি বলেন, তার বাবা রাষ্ট্রপতি ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আর তিনি চার-চারবার প্রধানমন্ত্রী। তার পরিবার দুর্নীতিই যদি করত, তাহলে দেশের মানুষকে আর কিছু দিতে পারত না। তারা দেশের মানুষকে দিতে এসেছেন। মানষের জন্য করতে এসেছেন। আওয়ামী লীগ বিদ্যুৎ উৎপাদন ২৫ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে গেছে। দেশের প্রতিটি ঘরে আলো পৌঁছে দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী জানান, তার সরকার আগামীর বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে প্রতিটি জনশক্তি স্মার্ট হবে। তারা প্রতিটি কাজ অনলাইনে করতে শিখবে, ইকোনমি হবে ই-ইকোনমি, সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে হবে। তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মযোগ্যতা-সবকিছুই আমরা ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে করব। ই-এডুকেশন, ই-হেলথসহ সবকিছুই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে হবে। আমি আশা করি, ২০৪১ সাল নাগাদ আমরা তা করতে সক্ষম হব এবং সেটা মাথায় রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের তরুণ সম্প্রদায় তারা যত বেশি এই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা শিখবে, তত আমরা দ্রুত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নানা অনুষঙ্গ ধারণ করে আমরা তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি।

তিনি বলেন, আমি একটা কথাই বলব, আমরা সব বাধা কাটিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে একটা বাধা এসেছিল করোনা, এরপর শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আমার আহ্বান, আমরা ওই যুদ্ধ চাই না, স্যাংশন চাই না। ওইগুলো বন্ধ করেন। সব দেশ স্বাধীন। স্বাধীনভাবে তার চলার অধিকার আছে। এই অধিকার সব দেশের থাকতে হবে। যুদ্ধ মানুষের ক্ষতি করে, যুদ্ধের ভয়াবহতা কী আমরা জানি। ’৭১ সালে তিনি বন্দিখানায় ছিলেন এবং তার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম সেসময়। সেসময় পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে মেয়েদের অত্যাচার স্মরণ করে বলেন, সব থেকে মেয়েরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় ওই যুদ্ধের সময়। তিনি বলেন, এজন্য যুদ্ধ চাই না। আমি বিশ্ব নেতাদের কাছে আহ্বান জানাব, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করেন। তাদের উসকানি দেওয়া বন্ধ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শান্তি চাই। কেবল কোভিড-১৯-এর অর্থনৈতিক অভিঘাত থেকে আমরা বের হয়ে আসছিলাম, সেখানে এই যুদ্ধ আর স্যাংশন আমাদের অগ্রযাত্রা নষ্ট করছে। উন্নত দেশগুলোও আজ হিমশিম খাচ্ছে, কতভাগ বিদ্যুতের দাম তারা বাড়িয়েছে। আমরা বাংলাদেশ এখনো ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। সেজন্যই আমি সবাইকে আহ্বান জানিয়েছি-যার যেটুকু জমি আছে, চাষ করেন বা উৎপাদন করেন। আমরা উৎপাদন বাড়িয়ে নিজেদেরটা নিজেরা খাব, কারও কাছে হাত পেতে চলব না। শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, আজ আওয়ামী লীগ এটুকু বলতে পারে, বাংলাদেশের কোনো মানুষ অভুক্ত থাকে না। তাই পিতাকে বলতে পারি-পিতা, আমরা কথা দিলাম, আপনার জনগণ কখনো অভুক্ত থাকবে না। আপনার জনগণ কষ্টে থাকবে না। আজ আপনি নেই, আপনার আদর্শ আছে। সেই আদর্শ নিয়ে জনগণের পাশে থেকে আমরা এই জনগণকে সুন্দর জীবন দেব, উন্নত জীবন দেব, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, আমরা সেভাবেই এই দেশ পরিচালনা করব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সম্পদ কম। জাতির পিতা বলেছিলেন, আমার মাটি আছে, মানুষ আছে, এই মাটি-মানুষ দিয়েই দেশ গড়ব। আমরাও সেই নীতিতে বিশ্বাস করি। আমরা পারব। দেশের মানুষের ওপর আমার আস্থা ও বিশ্বাস আছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল হিসাবে গঠনতন্ত্র মেনে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা ১০টি জেলা বাদে প্রতিটি জেলা ও অনেকগুলো উপজেলার সম্মেলন করেছি। যেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেগুলোর সম্মেলন আমরা করব। তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতা উদ্ধৃত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা উদ্ধৃত করে বলেন, ‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব। নবজাতকের কাছে এ আমার অঙ্গীকার।’ শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্যদিয়ে সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More