বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদকে মহাসাড়ম্বরে পুষ্পবৃষ্টিতে বিদায়
স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ মো. সাহাবুদ্দিন। আইন পেশা, বিচারালয় ও দুদকে দায়িত্ব পালনের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হলেন তিনি। সোমবার বেলা ১১টায় বঙ্গভবনের ঐতিহাসিক দরবার হলে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে তিনি শপথ নেন। রাষ্ট্রপতিকে শপথবাক্য পাঠ করান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। শপথে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার করেন নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। শপথ অনুষ্ঠানের পর বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ২২তম নয়া রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে মঞ্চে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানান এবং দায়িত্ব হস্তান্তরের অংশ হিসেবে নিজ নিজ আসন বদল করেন। তখন হাজারের বেশি অতিথির মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত হয় ভাবগম্ভীর মিলনায়তন। পরে আব্দুল হামিদকে মহাসাড়ম্বরে, পুষ্পবৃষ্টিতে বিদায় জানানো হয়। দেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে আর কোনো রাষ্ট্রপতির জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রাচারে এমন বিদায় অনুষ্ঠান দেখেনি বঙ্গভবন। বিদায়ী অনুষ্ঠানের আগে আব্দুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, রাজনীতিবিদদের দেশের মানুষকে ভালোবেসে রাজনীতি করা উচিত। তাহলেই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে। তিনি আর রাজনীতিতে জড়াবেন না বলেও জানান।
রাষ্ট্রীয় এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং শতাধিক বিশিষ্ট অতিথি উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
এর আগে কালো মুজিব কোট ও সাদা পাঞ্জাবি পরে নতুন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও স্পিকারকে নিয়ে সকাল ১০টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে প্রবেশ করেন। সেসময় একটি সামরিক ব্যান্ড আনুষ্ঠানিক সংগীত পরিবেশন করে। পরে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শপথ নথিতে স্বাক্ষর করেন। রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণের পর অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। আজ নতুন রাষ্ট্রপতিকে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়া হবে।
অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী ড. রেবেকা সুলতানা ও ছেলে আরশাদ আদনান রনিসহ পরিবারের সদস্য এবং বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের পরিবারের সদস্য, স্ত্রী রাশিদা খানম ও ছেলে ইঞ্জিনিয়ার রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক এমপিসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ডেপুটি স্পিকার, সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদের, জাতীয় সংসদের হুইপ, সংসদ-সদস্য, কূটনৈতিক মিশনের প্রধান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান, প্রতিমন্ত্রী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রিমকোর্টের বিচারক, বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল বা কমিশন বা ইনস্টিটিউটের প্রধান, জাতীয় রাজনৈতিক নেতা, তিন বাহিনীর প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি), বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকসহ সিনিয়র সাংবাদিক এবং উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাসহ প্রায় ১১০০ জনেরও বেশি আমন্ত্রিত অতিথি অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করেন।
এদিকে শপথ নেয়ার পর নতুন রাষ্ট্রপতিকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান দেশের বিশিষ্টজনরা। প্রথমে নতুন রাষ্ট্রপতিকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা। এরপর একে একে শুভেচ্ছা জানান বিশিষ্টজন ও আওয়ামী লীগ নেতারা।
মো. সাহাবুদ্দিনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের। সোমবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি-২ খন্দকার দেলোয়ার জালালীর সই করা এক অভিনন্দন বার্তায় তিনি রাষ্ট্রপতির সাফল্য, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
এর আগে ৭৩ বছর বয়সি এই রাজনীতিবিদ ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পাবনা শহরের শিবরামপুরের জুবিলী ট্যাংকপাড়ায় জš§গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শরফুদ্দিন আনছারী, মা খায়রুন্নেসা। তিনি ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে এলএলবি ও বিসিএস (বিচার) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
মো. সাহাবুদ্দিন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, পাবনা জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। জেলা বাকশালের যুগ্ম-সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পাবনা জেলার আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনায় তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। ওই সময় সামরিক স্বৈরশাসকদের রোষানলে তিন বছর জেল খাটেন এবং অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন।
মো. সাহাবুদ্দিন দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতাও করেছেন। তার অনেক কলাম বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। কর্মজীবনে তিনি জেলা ও দায়রা জজ এবং দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন পরপর দুবার বিসিএস (বিচার) অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। চাকরি থেকে অবসরের পর হাইকোর্টে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। দুদক কমিশনার হিসাবে তিনি পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিরুদ্ধে ওঠা তথাকথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দৃঢ়তার পরিচয় দেন। সাবেক এই ছাত্রনেতা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।