রাজনৈতিক উত্তাপের বছর শুরু : আপাতত সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ
রাজপথই বেছে নিচ্ছে আ.লীগ বিএনপি : রাজনীতিতে হতে পারে নানা মেরুকরণ
স্টাফ রিপোর্টার: শুরু হয়েছে নতুন বছর ২০২৩। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এ বছরে রাজনীতিতে ছড়াতে পারে উত্তাপ। নির্বাচনের পদ্ধতিসহ বেশকিছু ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে। সংকট নিরসনে আপাতত সংলাপ বা সমঝোতার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। উলটো নতুন বছরেও রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে দুদল। বিএনপিকে মোকাবিলার হুঁশিয়ারি দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, নতুন বছরে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। আন্দোলনের নামে সহিংসতার সৃষ্টি হলে তাদের প্রতিহত করা হবে। আওয়ামী লীগের এমন হুমকি তেমন আমলে নিচ্ছে না বিএনপি। সরকারবিরোধী দল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনকে আরও বেগবান করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সরকার পতনসহ ১০ দফা দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে তারা। সময়-সুযোগ বুঝে তা সরকার পতনের একদফায় রূপ নিতে পারে।
দুদলের এমন বিপরীতমুখী অবস্থানে সামনের দিনগুলো ভয়াবহ সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন সেক্টরে সংকট চলছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংকট ভয়ংকর রূপ নিলে তা দেশকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেবে। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের রাজনীতি সুস্থধারায় নেই। ক্ষমতা দখলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। নতুন বছরে আমাদের সবার প্রত্যাশা-রাজনৈতিক দলগুলোর শুভবুদ্ধির উদয় হোক। ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ ভুলে গিয়ে তারা জনকল্যাণমুখী রাজনীতির পথে হাঁটুক। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে রাজনৈতিক দলগুলোকে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংকট নিরসনে বের করতে হবে সমঝোতা বা সংলাপের পথ। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের বড় দুদলের কথাবার্তায় রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এর কোনো বিকল্প নেই। আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন আমাদের ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দেবে। আন্তর্জাতিকভাবে দেশ ভয়াবহ চাপের মুখে পড়বে। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সহজ হবে না। তাই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের সংকট নিরসনে এগিয়ে আসতে হবে। আশা করি, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে রাজপথে ফের সংঘাত-সংঘর্ষ, প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে; যা আমাদের অর্থনীতিকে আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনি বছরে রাজনীতিতে হতে পারে নানা মেরুকরণ। চলবে জোট ভাঙা-গড়ার খেলা। বর্তমানে যারা বন্ধু, ভবিষ্যতে তারাই হয়ে যেতে পারে প্রতিপক্ষ। সৃষ্টি হতে পারে নতুন রাজনৈতিক জোট। রাজনৈতিক অস্থিরতা সুষ্টি হলে সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে আন্তর্জাতিক মহল। ইতোমধ্যে দৌড়ঝাঁপও শুরু করেছেন তারা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী দেশগুলো দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ভোট ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের তৎপরতা আরও দৃশ্যমান হবে; যা দেশের রাজনীতিকে আরও জটিল করে দিতে পারে, দেশের জন্য মারাত্মক বিপদ ঢেকে আনতে পারে।
নতুন বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পুরোপুরি নির্বাচনমুখী। গেল বছরের শেষদিকে জাতীয় সম্মেলন শেষ করেছে দলটি। নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় কোনো পরিবর্তন আনেনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। ইতোমধ্যে ভোটের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে দলটি। নেতাকর্মীদের চাঙা করতে তৃণমূল ঢেলে সাজানোর কাজও প্রায় শেষের দিকে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। নানা ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আলোর মুখ দেখেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এ সরকারের আমলেই মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করেছে দেশ। এছাড়া আরও অনেক মেগা উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। আগামী নির্বাচনে সরকারের এ উন্নয়নের চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরবে দলটি।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করেন, বিগত সময়ে দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে, আগামী নির্বাচনে জনগণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখবে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে তারা ফের নৌকায় ভোট দেবেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসবে-এমনটা বুঝতে পেরে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে বিএনপি-জামায়াত। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে উদ্ভট কথাবার্তা বলছে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিএনপি বিতর্কিত করেছে, সেই সরকারের অধীনেই নির্বাচনের দাবিতে মাঠ গরমের চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হবে না। সংবিধান অনুযায়ীই হবে আগামী নির্বাচন। এ নিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থির করার অপচেষ্টা করলে এবার তাদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
মঙ্গলবার রাজধানীতে এক মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদারতায় বিএনপিকে অনেক ছাড় দেয়া হয়েছে। বেশি লাফালাফি করলে আর ছাড় দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগ সংঘাত চায় না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আক্রমণ করব না। তবে আঘাত এলে পালটা আঘাত হবে কি না, তা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
রোববার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। নির্বাচন গণতান্ত্রিক দেশের একটি সাধারণ বিষয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী, সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। আশা করি, সব দল তাতে অংশগ্রহণ করবে। তিনি বলেন, মীমাংসিত বিষয় নিয়ে কোনো দল বিশৃঙ্খলা ঘটনোর চেষ্টা করলে তা প্রশ্রয় দেয়া হবে না।
ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনমুখী হলেও নতুন বছরে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দল আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, নতুন বছরে রাজনীতির মূল ইস্যু হবে সবার অংশগ্রহণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতি নিশ্চিত করা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর কিংবা ২০২৪-এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। এর আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। সরকার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে রাজপথে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমেই তাদের বিদায় করা হবে। সরকারের সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়। রাজপথেই হবে ফয়সালা।
সূত্র জানায়, রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে নেতাকর্মীদের নামে নতুন মামলা ও গ্রেফতার নিয়ে কিছুটা চাপে আছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র অনেক নেতাই আছেন কারাগারে। কয়েক মাসে তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীকেও আটক করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উজ্জীবিত নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা ভীতি তৈরি হয়েছে। তবে মামলা ও গ্রেফতার নিয়ে চাপে থাকলেও সেটাকে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না দলটির নীতিনির্ধারকরা। তৃণমূলের চাঙাভাব ধরে রাখতে নানা পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, নতুন বছরে জনগণকে গণতন্ত্র উপহার দেয়ায় হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে তা কখনো সম্ভব হবে না। তাই সরকারের পতন ছাড়া আমরা বিকল্প ভাবছি না। রাজপথে সব দল ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই এর ফয়সালা হবে।
তিনি বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের কর্মসূচি পালন করে আসছি। ১০টি বিভাগীয় গণসমাবেশের পর সবশেষ গণমিছিল করেছি। কেউ বলতে পারবে না আমাদের নেতাকর্মীদের উসকানিতে কোথাও সংঘর্ষ হয়েছে। উলটো কোনো কারণ ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের কর্মসূচিতে হামলা চালাচ্ছে। গুলি করে নেতাকর্মীদের হত্যা করছে। তারপরও আমরা সংঘাতের পথে হাঁটছি না। তবে আওয়ামী লীগ যে পথে হাঁটছে, তাতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়া উপায় থাকবে না।