ভোট সামনে রেখে রাজনীতিতে চলছে নানামুখী তৎপরতা
নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই সাজানো হচ্ছে প্রশাসন
স্টাফ রিপোর্টার: সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোট সামনে রেখে রাজনীতিতে চলছে নানামুখী তৎপরতা। রাজপথেও উত্তাপ বাড়ছে। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে হাঁকডাক দিচ্ছে। একই অবস্থানে সংসদের বাইরে থাকা অন্য দলগুলোও। তবে যে কোনো পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ঠিক রাখতে নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর সরকার। নির্বাচনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে নিয়েই সাজানো হচ্ছে প্রশাসন।
জাতীয় নির্বাচনে প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনকেও চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। বিশেষ করে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বিশেষ ভূমিকায় থাকেন। এজন্য নির্বাচনকালে এসব পদে যতদূর সম্ভব বর্তমান সরকারের প্রতি ‘অনুগত’ এবং দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা কেমন হবে এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘দেশে অতীতের সব নির্বাচনেই প্রশাসন সহযোগিতা করছে। এবারও তাদের অবস্থান স্পষ্ট। নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতার জন্য আমাদের ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতা আছে। সেই ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতাকে আমরা কাজে লাগাব। আমরা নির্বাচনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাব।’
বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার ২২ ব্যাচের ২৬ জন কর্মকর্তা ডিসি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী জুন-জুলাই কিংবা আগস্টের দিকে এই ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হতে পারে। পদোন্নতির পর ২২ ব্যাচের ডিসিদের মাঠ পর্যায় থেকে তুলে আনবে সরকার। তাদের স্থলে ২৫ ব্যাচ এবং ২৭ ব্যাচ থেকে ডিসি নিয়োগ দেয়া হবে। ২৫ ব্যাচের ১১ জন বর্তমানে ডিসি পদে কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া বিসিএস ২৪ ব্যাচের ২৭ জন ডিসি হিসেবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। তবে ২৪ বিসিএস থেকে আর কোনো ডিসি নিয়োগ হবে না বলে গুঞ্জন রয়েছে। এ নিয়ে এ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। বিসিএস ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা ৩০০’র বেশি।
কর্মকর্তারা বলেন, আগামী নির্বাচন ২৪, ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কাঁধেই থাকবে। ফলে সামনের দিকে এসব ব্যাচ থেকে যাদের নিয়োগ দেয়া হবে তাদের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। সরকারের প্রতি শতভাগ অনুগতদেরই ডিসি পদে বসানো হবে। সাধারণত ‘সরকারপন্থি’ হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তারাই ডিসি হওয়ার ‘সৌভাগ্য’ লাভ করেন। বর্তমান সরকারের সময়ে দুজনকে ডিসি নিয়োগ দেয়ার পর তারা ছাত্রজীবনে ‘ছাত্রদলের’ রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এমন অভিযোগে তাদের নিয়োগ বাতিল করা হয়। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে তখন ক্ষোভও দেখা দেয়। ফলে সামনের দিকে ডিসি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও বেশি যাচাই-বাছাই করবে সরকার।
এদিকে আগামী নির্বাচনে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ৩৫ ও ৩৬তম ব্যাচের কর্মকর্তারাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পদে দায়িত্বে থাকবেন। এই দুই ব্যাচ বর্তমান সরকারের সময়েই নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের মধ্যে ৩৬তম ব্যাচের কর্মকর্তারা বর্তমানে সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে দায়িত্ব পালন করছেন। আর ৩৫তম ব্যাচ থেকে ইউএনও নিয়োগের জন্য ফিটলিস্ট তৈরি করা হয়েছে। শিগগিরই এ ব্যাচ থেকে ইউএনও পদে পদায়ন শুরু হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলা প্রশাসক (ডিসি) বলেন, নির্বাচনে জেলা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ডিসিরা। ফলে ডিসিদের ওপর ব্যাপক চাপ থাকে। এ চাপ সামলেই কাজ করতে হয়। নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করব। আমরা ভোট আয়োজনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।
প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতেও সম্প্রতি বড় পরিবর্তন এসেছে। আগামী নির্বাচনে তারাই প্রশাসন পরিচালনা করবেন। প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব হয়েছেন মো. তোফাজ্জল হোসেন। তিনি দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ এবং পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব হন। এরপর গত বছরের ৭ ডিসেম্বর তিনি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হন। আগামী জাতীয় নির্বাচনকালেও তিনি এ পদে থাকবেন। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব হয়েছেন মো. মাহবুব হোসেন। তার চাকরি আগামী বছরের ১৩ অক্টোবর শেষ হবে। তবে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব রাখা হতে পারে বলে ধারণা করছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। যদিও এটি একান্তই প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারের ওপর নির্ভর করবে। মাহবুবকে ঠিক নির্বাচনের আগে অক্টোবরে অবসরে পাঠিয়ে নতুন কাউকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব করার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ জানুয়ারিতে যদি ভোট হয় তাহলে নতুন কেউ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে প্রশাসন বুঝে উঠতে পারবেন না। ফলে ধরেই নেয়া হচ্ছে, নির্বাচনকালে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্বে মাহবুব হোসেনই থাকছেন।
আগামী নির্বাচন মাথায় রেখে পুলিশের বর্তমান আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দেড় বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তিনি বর্তমান সরকারের খুবই অনুগত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তার দক্ষতা ও যোগ্যতারও কোনো ঘাটতি নেই। ফলে তার ওপরই আস্থা রেখেছে সরকার। নির্বাচনকালে পুলিশপ্রধান হিসেবে তার বিশেষ ভূমিকা থাকবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে বিসিএস (পুলিশ) ২৪ ও ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা এসপি হিসেবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে তাদের অনেককেই তুলে আনবে সরকার। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনকালে ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা এসপি হিসেবে পদায়ন পাবেন। এ ব্যাচের কয়েকজন এরই মধ্যে এসপি হয়েছেন।
কর্মকর্তারা জানান, যে কোনো নির্বাচনেই পুলিশের বিশেষ ভূমিকা থাকে। গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে তাদের ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী নির্বাচনেও পুলিশের ভূমিকা থাকবে ‘উল্লেখযোগ্য’। ফলে থানার ওসি থেকে শুরু করে জেলার এসপি সবাই যেন প্রশাসনের প্রতি ‘অনুগত’ থাকে সে দিকটি নিশ্চিত করতে চায় সরকার।
গত ২৬ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক সম্মেলনের শেষ দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ উপহার দিতে ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ উপহার দেয়ার জন্য ডিসিদের তৈরি থাকার নির্দেশ দিয়েছি। বস্তুত নির্বাচনের সময় তাদের (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) করণীয় কিছুই থাকবে না। মন্ত্রণালয়গুলো শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। মূল দায়িত্বে থাকবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং ইসির কাছেই পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ যারা আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবে। সে জন্য আমরা সে সম্পর্কে বলেছি, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেশবাসী চাচ্ছেন। সারা বিশ্বও সেভাবে তাকিয়ে আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আপনাদের (ডিসি) ভূমিকা প্রাধান্য পাবে, মুখ্য হবে। সে জন্য আপনারা নিজেরা তৈরি থাকুন, যাতে জাতিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারেন। এই ছিলো কথা।