স্টাফ রিপোর্টার: কক্সবাজার জেলা জুড়ে টানা ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। অতিবর্ষণে পাহাড়ি ঢল, পাহাড় ধস ও বানের পানিতে তলিয়ে গিয়ে গত ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে নারী-শিশুসহ ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মাঝে বুধবার ভোররাতে পাহাড় ধসে মাটিচাপায় টেকনাফের হ্নীলা পাহাড়ের পাদদেশে একই পরিবারের ৫ জন আর মহেশখালীতে নিহত হন এক বৃদ্ধ। আর বানের জলে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে একই দিন। এছাড়া মঙ্গলবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুটি পরিবারে ৫ জন নিহতের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। বাকি ৩ জনও পৃথকভাবে পাহাড় ধস ও বানের জলে তলিয়ে মারা যায়। গত ৩দিনের অব্যাহত বৃষ্টির ফলে জেলার নয় উপজেলার প্রায় প্রতিটি এলকায় পানিবন্দি অবস্থায় দুর্ভোগে রয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। ঈদগাঁও ফুলেশ্বরী নদীর ঢলের তোড়ে ধসে গেছে ‘ঈদগাঁও-ঈদগড়-বাইশারী’ বাণিজ্যিক সড়কের প্রায় ১০০ ফুট এলাকা।
টেকনাফে পাহাড় ধসে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়েছে। বুধবার ভোররাত ২টার দিকে টেকনাফ উপজেলারর হ্নীলা ইউনিয়নের ভিলেজারপাড়ার সৈয়দ আলমের বাড়িতে এ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এ সময় মাটির নিচে চাপা পড়ে যাওয়া সৈয়দ আলমের ৫ সন্তানের মৃতদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। মঙ্গলবার পাহাড় ধসে টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকায় রকিম আলী (৪৭) নামে একজন নিহত হন। তিনি হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ১নম্বর ওয়ার্ডের মনিরঘোনা গ্রামের মৃত আলী আহমদের ছেলে বলে জানিয়েছেন হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী।
ভারী বর্ষণে কক্সবাজারে উখিয়ায় পাহাড় ধসে ও পানিতে ডুবে শিশুসহ ৬ জন রোহিঙ্গা নিহত হয় মঙ্গলবার। এ সময় আহত হয়েছে অন্তত আরও ৫জন। গতকাল বুধবার পালংখালীতে ও মঙ্গলবার উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় পাহাড় ধসে নিহত হন তারা।
অপরদিকে, ভারী বর্ষণে সৃষ্টি হওয়া বানের স্রোতে উখিয়ায় নিখোঁজ স্থানীয় তিন জনের মরদেহ বুধবার উদ্ধার হয়েছে। এরা হলেন উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চোরাখোলা এলাকার মৃত আলী আহমদের ছেলে আবদুর রহমান (৪৫)। রাজাপালং ইউনিয়নের ৯নম্বর ওয়ার্ডের ধইল্যাঘোনা এলাকার হাবিবুর রহমানের ছেলে আলী আকবর (৩৫) ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মালিয়ারকুল এলাকার মো. ইসলামের ছেলে মো. রুবেল (২২)।
পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, আবদুর রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বানের জলে ভেসে যান। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চোরাখোলা খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। রাজাপালং ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার হেলাল উদ্দিন বলেন, আলী আকবর ও রুবেল দুজনই শ্রমজীবী। তারা একটি আইএনজিওর হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করে ফেরার পথে বানের স্রোতে ভেসে নিখোঁজ হন। বুধবার দুপুরে তাদের মরদেহ মাছকারিয়া খালে পাওয়া যায়।
দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীততে পৃথক দুটি ইউনিয়নে এক বৃদ্ধ এবং এক কিশোরী পাহাড় ধসে নিহত হয়েছেন। নিহত বৃদ্ধ আলী হোসেন (৬৮) হোয়ানক ইউনিয়নে রাজুয়ার ঘোনার মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে। ঘুমন্ত অবস্থায় পাহাড় ধ্বসে তাদের বাড়ির ওপর পড়লে তিনি মারা যান।
অরপদিকে, মহেশখালী উপজেলার ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের সিপাহীপাড়া এলাকায় পাহাড় ধসে মোর্শেদা বেগম (১৪) নামে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে।
সূত্র মতে, সোমবার সকাল হতে শুরু হওয়া ভারি বৃষ্টিপাত থেমে থেমে অব্যাহত রয়েছে। টানা ভারী বর্ষণে কক্সবাজার জেলার শতাধিক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে সমতলও। পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া, রামু, পেকুয়া, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি বন্দি অবস্থা পার করছে কক্সবাজার শহরের বাজারঘাটা, কলাতলী, চরপাড়া, কাঙ্গালীপাড়া, সমিতিপাড়া, নাজিরারটেক, সদর উপজেলার খুরুশকুল, চৌফলদ-ি, পিএমখালী, পোকখালী, মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, ঘটিভাঙ্গা, পেকুয়ার মগনামা, উজানটিয়া, চকরিয়ার লইক্ষারচর, কাকারা, বরইতলী, পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড, কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, আলী আকবর ডেইল ও তাবলারচর এলাকা, ঈদগাঁও উপজেলার সদরের ভোমরিয়াঘোনা, দরগাহপাড়া, চৌধুরীপাড়া, পালপাড়া, মাইজপাড়া, ইসলামাবাদ, ইসলমাপুর ও জালালাবাদের পালাকাটা, সওদাগর পাড়া, বাজার এলাকাসহ পাশবর্তী এলাকার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। একই সাথে সাগরের জ্বলোচ্ছ্বাস ও পাহাড়ি ঢলে কয়েক হাজার একরেরও বেশি চিংড়ি ঘেরের মাছ তলিয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে পানের বরজ ও ধানসহ বিভিন্ন সবজির ফসল।
অপর দিকে, ঈদগাঁও উপজেলায় ঢলের পানিতে নিমজ্জিত দরগাহপাড়া এলাকায় স্রোতের মাঝে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ তিনজনের মরদেহ মিলেছে। বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আনু মিয়া সিকদারের ইটভাটার পাশের খালে তাদের মরদেহগুলো উদ্ধার করে দমকল বাহিনী ও নিখোঁজের স্বজনরা।
ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ছৈয়দ আলম জানান, ঈদগাঁও ফুলেশ্বরী নদীর ঢলে ডুবে থাকা দরগাহপাড়া-ভাদিতলা মুক্তিযোদ্ধা ছুরুত আলম সড়কের কাঠের সাঁকো এলাকায় বুধবার দুপুরে মাছ শিকার কালে নিখোঁজ হন দরগাহপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ শাহাজাহানের দুই ছেলে মোহাম্মদ ফারুক (২৬) ও দেলোয়ার হোসেন (১৫) এবং আবছার কামালের ছেলে মোহাম্মদ মোরশেদ (১৪)।
স্থানীয়দের পাশাপাশি দমকল বাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধারকাজে যোগদেয়। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে স্থানীয় খালে পৃথক জায়গা হতে তাদের তিনজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। রামু ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা সৌমেন বড়–য়াও তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আবদুর রহমান জানিয়েছেন, মঙ্গলবারের মতো বুধবারও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সোমবার ১২ টা হতে বুধবার ১২টা পর্যন্ত ৩৬ ঘন্টায় কক্সবাজার জেলায় ১৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামীকালও ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল সমূহে পাহাড় ও ভূমি ধসের সম্ভাবনা রয়েছে। সাগরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বলবৎ থাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিককের চেয়ে কয়েকফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মামুনুর রশীদ জানান, শ্রাবণের অতিবর্ষণে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। ঢল নেমেছে ঈদগাঁওর ফুলেশ্বরী, চকরিয়ার মাতামুহুরি ও রামুর বাঁকখালীতে। জলমগ্ন হয়েছে জেলার নয় উপজেলার সমতলও। শত শত বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে জলবন্দী হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। ডুবে গেছে রাস্তা-ঘাট। জেনেছি রান্নাও বন্ধ রয়েছে অনেক পরিবারে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া রয়েছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মানুষের দুর্ভোগ লাগবে কাজ করার।
পূর্ববর্তী পোস্ট
চুয়াডাঙ্গা পলাশপাড়ার সাংস্কৃতিককর্মী সিরাজ উদ্দিনের ইন্তেকাল
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ